মাটি পরীক্ষা করছে মুসা।
কি ধরতে চাও বলে ফেলো! হঠাৎ বলে উঠল সে। এই পায়ের ছাপগুলো দেখো আগে। তারপর বুঝবে মানুষ কিনা!
কাদামাটিতে বসে গেছে খালি পায়ের ছাপ, স্বাভাবিক আকারের নয় সেগুলো। আশেপাশে বড় আকারের বুটের ছাপও বসে গেছে গম্ভীর হয়ে।
দেখে মিইয়ে গেল কিশোর। একটু আগে যা বলেছে সেগুলোকে এখন বড় বড় কথা বলে মনে হতে লাগল। মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হলো ভয়ের সরু একটা সুতো। আরও নিশ্চিত হয়ে গেছে, কিডন্যাপাররা অবাস্তব কিছু নয়। তবে সাধারণ মানুষও নয়। এতবড় জুতো যে পরে, সেই মানুষটা কত বড়! ওজনও নিশ্চয় অনেক। আর সেই ওজন চর্বির নয়, মাংসপেশীর। ভয়াবহ সেই শক্তির নমুনা কিছুটা পেয়েছে আকামি।
শুধু গায়ের জোরই নয়, আরও নানা রকম ক্ষমতা আছে দৈত্যটার। এতবড় শরীর নিয়ে নিঃশব্দে হাজির হয়ে যেতে পারে, আকামির মত শক্তিশালী মানুষকে সহজে কাবু করে ফেলে, তালা খুলতে পারে, সামান্যতম শব্দ না করে চুরি করতে পারে একটা তেরো বছরের ছেলেকে, গরু চুরি করে; সবচেয়ে বড় কথা, একটা হাতির বাচ্চাকে খেদিয়ে নিয়ে চলে গেল, কেউ টেরও পেল না। অচেনা কেউ ধরতে এলে ভীষণ চেঁচামেচি করে হাতির বাচ্চা। তার মানে এই লোকটা হাতির ব্যাপারে অভিজ্ঞ।
অস্বস্তিটা মুখের ভাবে কিংবা আচরণে প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর।
বড় বড় বুটের ছাপ থাকায় সুবিধেই হয়েছে, বলল সে। অনুসরণ করা যাবে। নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব আমরা।
বিশ মিনিট পর দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কিশোর-মুসা। এগিয়ে চলল বুট ও হাতির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। সঙ্গে কয়েকজন কুলি, আর অবশ্যই আকামি ও মুংগা। কয়েকজন অতি উৎসাহী গ্রামবাসীও আসতে চেয়েছিল। বাধা। দিয়েছে সর্দার ওগারো।
মরতে চাও? হুঁশিয়ার করেছে সে। বজ্ৰমানবকে রাগিয়ে দিয়ে আমাদের সবাইকে মারতে চাও? এক হাতে টিপে এই গ্রামটা ভর্তা করে দিতে পারে সে। আউরো তো আমারই ছেলে, আমারও যেতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু আমি শুধু বাবাই। নই, আমি এ গাঁয়ের সর্দারও, সবার ভালমন্দ দেখার ভার আমার ওপর।
শুরুতে অনুসরণ বেশ সহজ হলো। মানুষের ছাপ যেখানে চোখে পড়ল না সেখানেও হাতির পায়ের বড় গোল গোল গভীর ছাপ পরিষ্কার দেখা গেল। দুনিয়ার আর কোন জানোয়ারই এত স্পষ্ট পায়ের ছাপ রেখে যায় না।
একেবারেই তো সহজ, হেসে উঠল মুসা। এই আরবগুলো ততটা চালাক নয়। শীঘ্রি দেখা পেয়ে যাব। তারপর বোঝাব মজা।
কিশোর কিছু বলল না। গভীর ভাবে পরীক্ষা করছে মানুষের পায়ের ছাপগুলো। আকামিকে জিজ্ঞেস করল, কয়জন মানুষ মনে হয় তোমার?
বারো…বড়জোর পনেরো।
আর আমাদের তিরিশ, সন্তুষ্ট হয়ে বলল মুসা। ব্যাটাদের খতম করে দেয়া কোন ব্যাপারই না।
কিন্তু ক্যাম্পে আরও লোক থাকতে পারে, কিশোর বলল। কথা হলো, এত স্পষ্ট ছাপ রেখে যাচ্ছে, এটা কি জানে না ওরা? নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল, নিশ্চয় জানে। বেশিক্ষণ আর অতটা সহজ থাকবে না। কোথাও না কোথাও কোন চালাকি খাটাবে। তোমরা সব সাবধানে থাকো, চোখকান খোলা রাখো।
সামনে বুনো ফুলের একটা বন, গাছগুলো ওদের মাথার চেয়ে উঁচু। ডালগুলো এত মোটা, ফুলগাছের বলে মনে হয় না। বিশাল মোমবাতির মত লাগছে খাড়া হয়ে থাকা বিশ ফুট উঁচু লবেলিয়াকে। চূড়ার কাছে ছড়িয়ে থাকা কুঁড়ির দিকে তাকালে মনে হয় আগুন লেগেছে ওখানে।
ফুলবন পেরোতেই বদলে গেল বনের চেহারা, শুরু হলো বাঁশঝাড়। অনেক উঁচুতে চোখা চোখা বাঁশপাতায় তৈরি চাঁদোয়াকে নীল আকাশের পটভূমিতে অনেক বেশি সবুজ লাগছে। কুয়াশার কারণে সব সময় ভিজে থাকে পাতা, ভেজা মাটিতে ঝরে পড়ে মুক্তোর মত পানির ফোঁটা টুপটাপ, টুপটাপ। বাঁশগুলোও স্বাভাবিকের চেয়ে মোটা, থামের মত।
এতটা বড় হতে নিশ্চয় অনেক সময় লাগে, মুসা বলল।
মোটেও না, মাথা নেড়ে বলল কিশোর, বাড়া দেখলে অবাক হবে। এক মিনিটের জন্যে এখানে মাটি শুকাতে পারে না। ফলে খেয়ে না খেয়ে বাড়তে থাকে। বাঁশ। দুই মাসেই একশো ফুট লম্বা হয়ে যায়। আমি বানিয়ে বলছি না।
মুসার চোখে অবিশ্বাস দেখে হাসল সে। অন্য গাছ বড় হতে যত সময় লাগে, তারচেয়ে অনেক কম সময় লাগে বাঁশ বড় হতে, খুব দ্রুত বাড়ে। কিন্তু এখানে যে হারে বাড়ে, তাকে বলতে হয় তীব্র গতি, কিংবা ঝড়ের গতি।
এত লম্বা বাঁশের বয়েস মাত্র দুই মাস! আমি বিশ্বাস করি না।
না করলেও ব্যাপারটা সত্যি। আর বড় হবে?
না, একশো ফুটই শেষ। এরপর কি ঘটবে?
ফুল ফুটবে। মাত্র একবার। তারপর মারা যাবে। ফুল থেকে যে বীজ ঝরবে সেগুলো থেকে নতুন চারা গজাবে। ওই যে দেখো একটা নতুন চারা, সবে গজানো শুরু হয়েছে।
মানুষের উরুর সমান মোটা ফুটখানেক উঁচু একটা বাঁশের চারার দিকে তাকাল মুসা।
কাল দিনের বেলায়ও এটা ছিল না এখানে, কিশোর বলল। রাতারাতি গজিয়ে গেছে।
কি করে জানলে?
পত্রিকা আর বই পড়ে। বৈজ্ঞানিক অভিযান চালানো হয়েছে এদিকটায়। অনেক মাপামাপি করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাঁশের চারা চব্বিশ ঘণ্টায় দুই ফুট করে বাড়ে। আস্তে আস্তে কমে আসে বাড়ার এই হার। তবে অনেক চারাই কমার সুযোগ পায় না।
কেন?
জন্তু-জানোয়ারে খেয়ে ফেলে। খেতে খুব ভাল, নরম, রসাল।