.
০৫.
ভীষণ গোলমালে চমকে ঘুম থেকে জেগে গেল ওরা। প্রচণ্ড হই-হট্টগোল!
অনেক মানুষের কণ্ঠ, মহিলাদের কান্না, বাচ্চাদের তারস্বরে চিৎকার, রেগে যাওয়া পুরুষের ধমক-সব মিলিয়ে এক এলাহি কাণ্ড।
বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে একদৌড়ে তাবুর বাইরে চলে এল মুসা। প্রথমেই খেয়াল করল, হাতির বাচ্চাটা নেই।
খাঁচার কাছে দৌড়ে এল সে। পেছনে এল কিশোর।
শূন্য খাঁচা।
সারা গায়ে তুমুল হই-চই। লম্বা, বেঁটে, দুই প্রজাতির মানুষেরাই ভীত পিঁপড়ের মত আতঙ্কে ইতস্তত ছোটাছুটি করছে।
শূন্য খাঁচাটার কাছে, দুই গোয়েন্দার পাশে এসে দাঁড়াল সর্দার ওগাররা।
হাতিটাকে নিয়ে গেছে, কিশোর বলল।
কথাটাকে গুরুত্বই দিল না সর্দার। আরও জরুরী দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে সে।
আমার ছেলেকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল সে। কান্নার পর্যায়ে চলে গেছে তার কণ্ঠস্বর, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হয় নিয়ে গেছে!
আরও কয়েকজন গ্রামবাসী দৌড়ে এল দুটো গরু হারানোর খবর নিয়ে। উয়াটুসিদের কাছে মানুষের চেয়ে কম দামী নয় গরু। ভাল হলে তো কথাই নেই। কিন্তু গ্রাম থেকে আসা মহিলা কণ্ঠের বিলাপ আর কান্না গরুর জন্যে নয়। কাঁদছে। সর্দারের ছেলে আউরোর জন্যে, তার মা।
গাঁয়ের সর্দার, অবশ্যই সাধারণ লোকেদের মত হবে না। তার ঘরবাড়িও অন্যদের চেয়ে আলাদা। দরজায় তালা লাগানোর ব্যবস্থা আছে তার ঘরে। গায়ের। একমাত্র তালা। সেই ঘর থেকে আউরোকে নিয়ে যাওয়া একটা বড় রহস্য।
দরজায় তালা ছিল না? জানতে চাইল কিশোর।
নিশ্চয় ছিল, সর্দার জানাল।
তাহলে ঢুকল কি করে লোকটা?
তুমি বুঝতে পারছ না, ও মানুষ নয়, দুষ্ট প্রেত, স্বয়ং বজ্রমানব। আর প্রেতের জন্যে তালা কোন ব্যাপার নয়।
রাতে তো দু-জনকে পাহারা রেখেছিলাম, বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল মুসা। ওদের তো দেখছি না! কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল নাকি?
আকামি আর মুংগাকে দেখেছে নাকি কুলিদের জিজ্ঞেস করল কিশোর। না, দেখেনি ওরা।
খাঁচার আশপাশের সমস্ত ঝোঁপঝাড় খুঁজে দেখা হলো। এক জায়গায় ঝোঁপের ডাল ভাঙা, দোমড়ানো। ঘাস দলিত মথিত। লড়াই হয়েছে যেন ওখানটাতে।
বনের অনেক ভেতরে ঢুকেও খোঁজা হলো।
ঘাবড়ে গেল কিশোর, দু-জন অভিজ্ঞ লোককে হারাল না তো? আকামি আর মুংগা না থাকলে এই অভিযানই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার, এই যে, ওরা এখানে!
দৌড়ে এল কিশোর। একটা বড় পাথরের ফাটলে পড়ে আছে দু-জন লোক। হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা। মারধরও করা হয়েছে।
মুখের কাপড় খুলে, বাঁধন কেটে দেয়া হলো ওদের।
কি হয়েছিল? জানতে চাইল কিশোর।
লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না আকামি। কি আর বলব! মুংগা ঘুমাচ্ছিল, আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। চোখ বন্ধ করিনি, তবে খুব ক্লান্তি লাগছিল। কাউকে আসতে দেখলাম না, শুনলামও না কিছু, হঠাৎ কে যেন মুখ চেপে ধরল। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। আমার মুখে কাপড় খুঁজে দেয়া হলো। ঘুমের মধ্যেই মুংগার মুখেরও কাপড় খুঁজে বেঁধে ফেলল। আমি অনেক ধস্তাধস্তি করলাম, কিন্তু ছুটতে পারলাম না। আমাকেও বেঁধে ফেলল। তারপর এখানে এনে ফেলে দিয়ে চলে গেল।
বেশি লোক?
অনেক।
কি ধরনের মানুষ ওরা?
দেখিনি। তবে ওরা যে কালো মানুষ নয়, এটুকু বুঝেছি। সাদাও নয় ওরা।
কি যা-তা বলছ। ওদের দেখইনি, গায়ের রঙ বুঝলে কি করে?
গন্ধ থেকে। ওদের গায়ে রোদ আর মাটির গন্ধ নেই কালো মানুষদের মত। সাদা মানুষের মত তামাকের গন্ধও নেই। ওদের গায়ে চা আর পুদিনার গন্ধ। ওরা নাবিক, জাহাজে করে উত্তর থেকে মোমবাসায় এসেছে।
আরব! অনুমান করল কিশোর। কিন্তু আরবরা এই পার্বত্য অঞ্চলে কি করতে এসেছে?
আরবদের সম্পর্কে এ সব কথা বুঝতে পারছে না আউরো।
ওরা হলো দুষ্ট প্রেত, বলল সে। আর ওদের সর্দার হলো বজ্রমানব। ও এসেছিল?
বজ্রমানবের কথা আমি কিছু জানি না, আকামি বলল।
তার মাথা থাকে তারার দেশে। কথা বলার সময় গলা দিয়ে বজ্রের গর্জন বেরোয়, চোখের দৃষ্টিতে জ্বলে বিদ্যুতের চমক।
বজ্র বা বিদ্যুৎ কোনটাই ছিল না আমাকে যখন ধরল।
বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আউরো। গলা বন্ধ করে রেখেছিল, চোখ করে ফেলেছিল অন্ধকার, যাতে আওয়াজও না হয়, আলোও দেখা না যায়। হলে যে আমরা জেগে যাব। কিন্তু ষাঁড়ের মত শক্তিশালী আর গাছের সমান লম্বা একজনকে তো নিশ্চয় দেখেছ?
অন্ধকারে ওসব কিছুই দেখিনি। তবে গায়ে মোষের জোর আছে এ কথা বলতে পারি। প্রথমে কয়েকজন চেপে ধরল আমাকে। ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলাম। তারপর দুটো হাত এসে পড়ল আমার গায়ে। পিষে ফেলতে শুরু করল। দুর্বল করতে করতে একেবারে পানি বানিয়ে দিল আমাকে। কারও হাতে এত শক্তি আর দেখিনি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ওগারো। ওই তো বজ্ৰমানব! আমার ছেলেকে নিয়ে গেছে। আর কোনদিন তাকে পাব না। কোন মানুষ লড়াই করে পারে না বজ্রমানবের সঙ্গে।
আমরা লড়াই করব তার সঙ্গে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল কিশোর, এবং আমরা পারবও! আপনার ছেলেকেও ফিরিয়ে আনব, যদি সে বেঁচে থাকে। সর্দার, কিছু মনে করবেন না, আপনার ভূতের গল্প আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। গরু যে চরি করে, সে আধিভৌতিক কিছু নয়, আমার-আপনার মতই মানুষ। বাজি ধরতে পারেন আমার সঙ্গে।