নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করল কিশোর। বনবন ঘুরতে লাগল যেন মগজের চাকাগুলো। বেড়ালছানাটার জন্যে উদ্বিগ্ন হবেই হুবার। জানালার ভাঙা ফোকরে মুখ রেখে বেড়ালের স্বর নকল করে ডেকে উঠল, মিআউ।
.
০৮.
মিআউ! মিআউ! মিআউ।
ডেকেই চলল কিশোর। করুণ, ক্ষুধার্ত বেড়ালছানার ডাক। যে কারও হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।
নিজের ডাক অন্যের মুখে শুনে প্রথমে কেমন অবাক হয়ে গেল ছানাটা। কিশোরের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার জন্যে মোড়ামুড়ি শুরু করল। না পেরে সুর মিলিয়ে ডাকতে আরম্ভ করল মিআউ মিউ করে।
ফিসফিস করে ছানাটাকে উৎসাহ দিল কিশোর, গুড, চালিয়ে যা। আরও জোরে।
ওটাও চেঁচিয়েই চলল।
নিজে ডাকাডাকি বন্ধ করে কান পাতল কিশোর। ঘরের মধ্যে কোন শব্দ হয় কিনা শোনার চেষ্টা করল।
হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে। কেউ নড়ছে। হালকা পায়ের শব্দ। থেমে গেল। রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল একজন লোক, যেটা দিয়ে হলঘরে ঢোকা যায়।
এই লোকই নিশ্চয় হুবার–ভাবল কিশোর। ভাল করে তাকাল লোকটার দিকে। পরনে শার্ট-প্যান্ট। ড্রেসিং গাউন আশা করেছিল সে। এখনও কিশোর আর ছানাটাকে দেখতে পায়নি। রান্নাঘরের ভেতরে এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছে। বুঝতে চাইছে কোনখান থেকে আসছে শব্দটা।
লোকটার বয়স খুব বেশি না। তরুণই বলা চলে। পাতলা মুখ। উজ্জল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চুল সুন্দর করে পেছন দিকে আঁচড়ানো। দেখে মনেই হয় না এই লোক রাত দুপুরে ভয়ে ঘর ছেড়ে পালাতে পারে।
মিআউ!
আবার কিশোরের হাত থেকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করল ছানাটা।
জানালার দিকে তাকাল নোকটা। কিশোরের কাধ আর মাথা চোখে পড়ল। বড় মানুষ ভেবে ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে হলে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। ফিরে তাকাল। ভাল করে দেখে বুঝল কিশোর বড় মানুষ নয়। ওর হাতে রয়েছে বেড়ালছানাটা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সে। ধরা পড়ে গিয়ে বিব্রত বোধ করছে যেন।
জানালার ফোকরের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিশোর বলল, এটা আপনার বেড়াল? খিদেয় মিউ মিউ করছিল। বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়েছি।
হাত দিয়ে ডলে চুল সমান করল লোকটা। জবাব দিল, হ্যাঁ, আমার। দাঁড়াও, দরজাটা খুলে দিচ্ছি।
দরজার তালা আর ছিটকানি খুলল লোকটা। সাবধানে পাল্লা খুলে হাত বাড়াল, দাও।
কিশোর বুঝতে পারল, ছানাটা ওর হাতে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে দরজা লাগিয়ে দেবে নোকটা। কথা বলার আর সুযোগ দেবে না। তাই ছানাটাকে আগের মতই ধরে রেখে বলল, আপনার ঘরে চোর ঢোকা নিয়ে গায়ে মহা উত্তেজনা। এখানে পুলিস এসেছিল, জানেন?
অবাক মনে হলো হুবারকে। পুলিস! কেন? বাড়িতে যে লোক ছিল না জানল কি করে?
দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। দুধওয়ালা যে সারা গায়ে খবরটা রটিয়েছে, হবার তাহলে জানে না। ফগ এসে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে এ কথাও জানে না। তার ধারণা, কেউ কিছু জানে না। এমনকি সে যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এ কথাও নয়।
কি হয়েছিল, বলছি সব, হুবারের পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল কিশোর।
বাধা দিল না হুবার। বরং কি ঘটেছিল শোনার জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রান্নাঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। কিশোরকে বসার ঘরে নিয়ে এল।
জিনিসপত্র সব এখন গোছগাছ করা। বাড়ি ফিরে আবার সব সাজিয়ে ফেলেছে হুবার।
বেড়ালটাকে ছেড়ে দিয়েছে কিশোর। মিউ মিউ করে ওদের পিছু নিল ওটা।
দুধ চাস নাকি? ছানাটাকে জিজ্ঞেস করল হবার। সরি, দিতে পারব না। দুধওয়ালা আসেনি আজ।
পুলিস বোধহয় আসতে মানা করে দিয়েছে, একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল কিশোর। বলেছে আপনি বাড়ি নেই।
পুলিসের এত ঠেকা পড়ল কেন এসে খোঁজাখুজি করার? বিরক্ত হয়ে বলল হুবার। কেউ কি বাড়ি ফেলে দুচার দিনের জন্যে বাইরেও যেতে পারবে না?
পুলিস খবর পেয়েছে চোর ঢুকেছে আপনার বাড়িতে। জিনিসপত্র সব ওলটপালট হয়ে ছিল। হুবারের চোখের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করল কিশোর, ওর কথা শুনে লোকটা চমকে যায় কিনা। জিজ্ঞেস করল, বাড়ি ঢুকে সব অগোছাল দেখতে পাননি?
দ্বিধা করতে লাগল হুবার। আর কিছু যেন বলতে চায় না। শেষে আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, তা পেয়েছি। কিন্তু পুলিশকে খবর দিল কে?
দুধওয়ালা। ছানাটাকে পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে দেখে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল কিশোর। দুধ দিতে এসে দেখে সামনের দরজা খোলা। সন্দেহ হয় তার। ডাকাডাকি করে আপনাকে না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে জিনিসপত্র সব তছনছ। তখন পুলিসকে খবর দেয় সে।
ও, তাই নাকি! আমি কিছুই জানতাম না।
বাড়ি থেকে কখন বেরিয়েছিলেন আপনি? আচমকা প্রশ্ন করল কিশোর। জবাবটা জানা আছে ওর। হুবার সত্যি বলে কিনা মিলিয়ে দেখতে চায়।
আবার দ্বিধা করতে লাগল হুবার। আগের রাতে। বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। গতরাতে ফিরেছি। ফিরে দেখি জিনিসপত্র সব ছড়ানো। তবে কোন কিছু চুরি হয়নি। আমার অনুমতি ছাড়া এ ভাবে নাক গলানো উচিত হয়নি পুলিসের।
দরজা খোলা থাকাতেই এই বিপত্তিটা ঘটল আরকি। আপনি কি দরজা লাগিয়ে গিয়েছিলেন?
নিশ্চয়ই।
বিশ্বাস করল না কিশোর। রাতে কি চোর এসেছে সাড়া পাওয়ার পরে পালিয়েছিল নাকি, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল। কিন্তু করল না। জানে, সত্যি জবাব পাবে না। এখন তো শার্ট-প্যান্ট পরা আছে। পায়ে জুতো। ড্রেসিং-গাউন আর স্লিপারটা কোথায় খুলে রেখেছে হুবার? ওপরতলায়? দেখতে পারলে হত।