ওই সময়ও কি হুবারের বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছ?
দেখেছি। মজার ব্যাপার কি জানো, আলোটা দেখেছি রান্নাঘরে। ইলেকট্রিক আলো নয়। টর্চ কিংবা মোমবাতিটাতি হবে।
মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠছে রবিন, কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না কিটিকে। রান্নাঘরে আলো জ্বেলেছে নিয়ে সেই লোকটা, যে জানালা ভেঙে ঢুকেছে।
কিসের শব্দে ঘুম ভাঙল, বুঝতে পারনি? ভেবে দেখো তো, কাঁচ ভাঙার শব্দ কিনা?
তা হতে পারে, ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে তাকাল কিটি। চোর ঢোকার কথা ভাবছ নাকি তুমি? শোনো, কাঁচ ভাঙার শব্দই নি, আর যেটাই নি, আমার তাতে কোন আগ্রহ নেই। রান্নাঘরে কিসের আলো দেখেছি তা নিয়েও আমার মাথাব্যথা নেই। তা ছাড়া ঠিক ঠিক দেখেছি কিনা তাও বলতে পারব না। ঘুমের ঘোরে ভুলও দেখে থাকতে পারি।
অনেক কথা বলে ফেলেছে কেবল রবিনের কাছ থেকে টা পড়তে পাওয়ার কৃতজ্ঞতায়! আর নয়। বইয়ের পাতায় মুখ নামাল খাবার কিট।
আর কথা বলতে চায় না ও, বুঝল রবিন। উঠে দাঁড়াল। অনেক জেনেছে। এতটা জানতে পারবে আশা করেনি।
গুডবাই, কিটি।
গুড-বাই, বই থেকে মুখ না তুনেই জবাব দিল ফিটি। বইটা কবে ফেরত দেবে না দেবে কিছুই বলল না।
রবিনও কিছু জিজ্ঞেস করল না। দরজার দিকে হাঁটা দিল।
বাড়ি ফিরেই ফোন করল কিশোরকে। সব কথা জানাল।
বাহ্, অনেক কথা জেনে এসেছ তো, খুশি হলো কিশোর। বোঝা যাচ্ছে, জানালার কাঁচ ভেঙে রাত তিনটের পর লোকটা ঢুকেছিল হুবারের রান্নাঘরে, এবং তারপরে ছুটে পালিয়েছে হুবার। হয়তো সঙ্গে করে নিয়ে গেছে সেই জিনিসটা, যেটার জন্যে লোকটা এসেছিল।
আরও দুচারটা কথা বলে, রবিনকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রেখে দিল কিশোর। চৌকিদারদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে বেরোতে হবে তাকে।
০৬.
সকাল সকাল খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে নিল কিশোর। টিটুকে নেবে কিনা ভাবতে লাগল। প্রয়োজন মনে করল না। বরং রাতের বেলা ওকে সামলানোই ঝামেলা। ইঁদুর, ছুঁচো আর এ জাতীয় নিশাচর জীবের আনাগোনা হবে। সেটা কানে যাবে টিটুর। আর গেলেই হই-চই। তার চেয়ে রেখে যাওয়াটা ভাল মনে করল সে।
সে যে বেরোচ্ছে এটা বুঝতে দিল না টিটুকে। ঘরে আটকে রেখে বেরিয়ে চলে এল।
কোনদিকে যাবে?
পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়েছে হুবার। সেদিকে নদী। অতএব প্রথমে নদীর দিকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। তবে তার আগে অনুমান করে নিতে হবে, ঠিক কোনদিকে গিয়েছে হুবার।
তাই চলে এল হুবারের বাড়ির পেছনে।
পুরো অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটা। পেছনের দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তাটার দিকে তাকাল। ঘঁ, ঠিকই অনুমান করেছে। নদীর দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
হাঁটতে শুরু করল রাস্তা ধরে। এদিকে যে সব চৌকিদার পাহারা দেয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
আস্তে আস্তে হেঁটে চলল। চলে এল পথের শেষ মাথায়। এখানে রাস্তাটা ভাগ হয়ে দুটো পথ দুদিকে চলে গেছে। এদিক ওদিক তাকাল। কোনও চৌকিদার চোখে পড়ল না।
এখন কোনদিকে যাবে? ডানে, না বায়ে?
ডানেরটাতে যাওয়াই ঠিক করল।
এবার ভাগ্য কিছুটা অসন্ন হলো। একসারি সাল গঠন জ্বলছে। তার মাঝে আবছামত দেখা যাচ্ছে চৌকিদারের কুঁড়ে। দরজায় একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল। তারমানে কেউ আছে ওখানে।
কিশোর কাছাকাছি এগোতেই পায়ের শব্দ শুনে গলা বাড়িয়ে দিল লোকটা। জ্বলন্ত কয়লায় হাত সেঁকছে।
কাছে গিয়ে কিশোরও হাত দুটো ধরল কয়লার ওপর। উফ, একেবারে অবশ হয়ে গেছে। লোকটার দিকে তাকাল, কেমন আছেন?
কে হে তুমি? এত রাতে?
ঠেকা না থাকলে এই ঠাণ্ডার মধ্যে বেরোয় কোন পাগলে, প্রচণ্ড বিরক্তির ভান করে বলল কিশোর। নিজের পরিচয় দিল না। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, কি আর বলব, কতগুলো উন্মাদ এসে জুটেছে বাড়িতে। এই যে আমার আঙ্কেল পমের কথাই ধরুন না। রাত দুপুরে ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যেস। বলে নিশির ডাক। বাইরে বেরিয়ে কোথায় কোনদিকে চলে যায়, কোন ঠিকঠিকানা নেই। সকালে আর কিছু মনে করতে পারে না। বলুন তো কি কাণ্ড।
আজও বেরিয়েছে নাকি? জিজ্ঞেস করল চৌকিদার।
কাল রাতে বেরিয়েছিল। এদিকে এসেছিল নাকি, দেখেছেন? পাজামা পরা, পায়ে চটি। বিছানা থেকে নেমে বেরিয়েছে তো, ওগুলোই পরা ছিল। বড়জোর একটা কোট গায়ে দিয়ে থাকতে পারে। ঠাণ্ডা যে লাগে, এ ব্যাপারে পাগলেরও হুশ থাকে।
হেসে উঠল চৌকিদার। না, ওরকম কোন পাগলকে দেখিনি কাল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে, যেন কেউ শুনে ফেলবে এই ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, শোনো, তোমাকে বলেই ফেলি-কাউকে বলে দিয়ো না আবার, ফগ শুনতে পেলে চাকরিটা যাবে-কাল রাতে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই কিছু দেখিনি। এই ঠাণ্ডার মধ্যে কে যায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে, বলো। একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, তবে বুড়ো ক্যামার ঘুমায়নি। ও ঠিকমতই পাহারা দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে চলে গিয়েছিল। ও নাকি পাজামা পরা এক লোককে দেখেছে। অত রাতে ওই পোশাকে নদীর ধারে লোকটাকে দেখে অবাক লেগেছে তার। সেজন্যেই বলেছে আমাকে। এখন বুঝলাম, পাগলটা কে। তোমার আঙ্কেল পম। পাগল বললাম বলে আবার কিছু মনে করলে না তো?
আরে না না। আমিই তো বললাম পাগল।
পাগল যখন জানোই, ঘরের মধ্যে রাতে তালা আটকে রাখো না কেন? নইলে কোনদিন রাতে নদীতে পড়ে ডুবে মরবে কে জানে।