হেসে ফেলল ওয়ালি, বোট-হুক লাগবে না?
কিশোরও হাসল, না। জলজ উদ্ভিদে আমারও খুব আগ্রহ। তবে ওই বিজ্ঞানীর মত এত কষ্ট করার কোন ইচ্ছে নেই। বরং তাকে খুঁজে বের করে কয়েকটা প্রশ্ন করব উদ্ভিদের ব্যাপারে। কোনদিকে গেছে?
হাত তুলে নদীর কিনার ধরে এগিয়ে যাওয়া পায়েচলা পথটা দেখিয়ে দিল ওয়ালি।
তোমরা বসো, বন্ধুদের বলল কিশোর, আমি দেখে আসি। রওনা হয়ে গেল সে।
১১.
হনহন করে হেঁটে চলেছে কিশোর। নজর সামনের দিকে।
নদীর একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা পেয়ে গেল লোকটার। লম্বা একটা বোট-হুক দিয়ে পানিতে খোঁচাচ্ছে। পাশে রাখা একটা বেতের হাতলওয়ালা বড় ঝুড়ি। পানি থেকে নানা রকম উদ্ভিদ তুলে তাতে ভরছে।
একটা মুহূর্তের জন্যে সন্দেহ হলো কিশোরের, লোকটা সত্যি উদ্ভিদবিজ্ঞানী নয় তো? কিন্তু চেহারা দেখে পরক্ষণে বাতিল করে দিল ভাবনাটা। কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে ফিরে তাকাল লোকটা।
নিরীহ ধরে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কি তুলছেন?
জবাব দিল না লোকটা। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আপনার ঝুড়িতে নিশ্চয় অনেক শামুক জমা হয়েছে। বেছে নিতে পারি? আমি একটা হাঁস পালি…।
ধমকে উঠল লোকটা, খবরদার, ঝুড়িতে হাত দেববেনা। শামুকের এত দরকার হলে নিজেই ধরে নাওগে না।
আমার মনে হয় এদিকটাতে শামুক অনেক বেশি। এখন থেকেই পরি।
না! গর্জে উঠল লোকটা। এখানে না। আমার নানা নষ্ট করবে। অন্য কোথাও যাও। সারা নদীতেই শামুক ভর্তি।
দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই লোক বিজ্ঞানী নয়।
গেলে না এখনও? হুক তুলল লোকটা। কথা না শুনলে যেন কিশোরের বুকেই বিধিয়ে দেবে। যাও, ভাগো এখান থেকে।
বাবারে! কি কাণ্ড! গ্রীনহিলসের সবাই আজকাল ফগের মুদ্রাদোষের শিকার হতে আরম্ভ করেছে নাকি? ফগ তো বলেই, হুরও বলে যাও, ভাগো! এই লোকটা বলে যাও, ভাগো!
আরেকবার যাও, ভাগো শোনার আগেই তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এল কিশোর। গেল না মোটেও। একটা ঘন ঝোপে বসে চোখের সামনে থেকে দুটো ডাল সরিয়ে উঁকি দিয়ে রইল।
আবার পানিতে খোঁচাতে শুরু করল লোকটা। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। কিশোর কোনখান থেকে উঁকি মেরে আছে কিনা দেখছে বোধহয়।
পানিতে যে কোন্ জিনিস খুঁজছে, তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের।
হুকে কি যেন বাধল লোকটার। টেনে তুলে আনল। একটা পুরানো জুতো। হক থেকে ওটা খুলে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে পানিতে ছুঁড়ে ফেলল আবার।
হুকে আটকে কয়েকটা জলজ উদ্ভিদ উঠে এল। ওগুলো খুলে নিয়ে ঝুড়িতে ভরল সে।
এটা ভান। কেউ যদি নজর রেখে থাকে তাহলে যাতে মনে করে এই লোক সত্যি জলজ উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, আসলে খুজছে সে অন্য জিনিস।
পানি থেকে আবার একটা ফালতু জিনিস উঠে এল হুকে আটকে। আগের মতই বিরক্ত ভঙ্গিতে ওটা পানিতে ফেলে দিল লোকটা।
ফগ কি করছে জানার খুব কৌতূহল হলো কিশোরের। একের পর এক এ সব জিনিস উঠতে থাকলে ফগও বেজায় বিরক্ত হবে। কল্পনায় ওর মুখভঙ্গি দেখতে পেয়ে একা একাই নীরবে হাসতে লাগল সে।
মুসারা ওদিকে অপেক্ষা করছে ওয়ালির ছাউনিতে বসে।
ফগ এল। সাইকেল রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে জিজ্ঞেস করল, কি, হয়েছে?
এই যে, হয়ে গেছে, জবাব দিল ওয়ালি। দাঁড়ান, নামিয়ে দিচ্ছি।
ওরা যে লুকিয়ে আছে এটা যাতে টের না পায়, এ জন্যে টিটুর মুখ চেপে ধরে আছে ফারিহা। টেরিয়ারটা চুপচাপ বসে আছে মুসার পায়ের কাছে। ওটা শান্ত কুকুর। টিটুর মত এত চঞ্চল নয়।
কোনমতেই টিটুর মুখ বন্ধ রাখতে পারল না ফারিহা। ফগের গন্ধ পেয়েই খই খউ শুরু করল!
ওর কণ্ঠ ফগের পরিচিত। দরজায় এসে উঁকি দিল। ঝামেলা! এখানেও এসে বসে আছে। এই, তোমাদের পালের গোদাটা কই?
জানি না, সাফ জবাব দিয়ে দিল মুসা।
জলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এখানে বসে থাকলে থাকো, কিছু বলব না। কিন্তু আবার যদি আমার কাজে নাক গলাতে এসেছ তো ভাল হবে। তোমাদের বিচ্ছু বন্ধুটাকেও সাবধান করে দিয়ো।
ফারিহার হাত থেকে ছুটে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো টিটু। গলা ছেড়ে হাঁক দেয়া বাদে ওর আর করার কিছু রইল না।
বেশি সময় নষ্ট করল না ফগ। নৌকায় চেপে বসল। হুক দিয়ে খুঁজতে শুরু করল পানিতে। আগের রাতে বুড়ো ক্যামারের কাছে জেনে নিয়েছে নদীর ঠিক কোন্খানটাতে নেমেছিল পাজামা পরা লোকটা।
নৌকায় করে ঘুরতে ঘুরতে একের পর এক বিরক্তিকর জিনিস তুলে আনতে লাগল পানির নিচ থেকে। সেগুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগল আর ঝামেলা। ঝামেলা! করতে থাকল। হঠাৎ চোখ পড়ল, তীরে দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছে ছেলেমেয়েগুলো। গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। মশার দল আবার এসেছে বিরক্ত করতে। মশা! হ্যাঁ, মশাই! তফাৎটা কেবল, মশা কামড়ানোর জন্যে গায়ে বসলে থাপ্পড় মেরে প্রতিশোধ নেয়া যায়। এগুলোকে যায় না। কবে ঠাণ্ডা করে দিত, কেবল ক্যাপ্টেন রবার্টসনের জন্যে পারে না।
রাগ কমানোর জন্যে পানিতে ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে হুক দিয়ে খোঁচাতে লাগল। উঠে আসতে লাগল নানা রকম জঘন্য জিনিস। মেজাজ আরও খারাপ করে দিল ওর।
তারপর এক সময় এমন একটা জিনিস উঠল, উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। একটা লন্ড্রি ব্যাগ। ওখানে বসেই তাড়াতাড়ি ওটার মুখ খুলে ফেলল সে। যা বেরোল, তাতে আবার থমথমে হয়ে গেল মুখচোখ। অতি সাধারণ বাতিল কতগুলো কাপড়-চোপড়। কোন শিশুর হবে। অকাজের জিনিস, তাই কেউ ব্যাগে ভরে এনে পানিতে ফেলে দিয়ে গেছে। ব্যাগটা যাতে ডুবে থাকে, সেজন্যে তাতে ভারী পাথর ভরে দিয়েছে।