জানালায় উঁকি দিল হেলমেট পরা একটা লাল টকটকে মুখ। ফার্যাম্পারকট।
চিৎকার করে উঠল হবার, কে? পুলিস। আবার এসেছে। এর একটা বিহিত না করলেই নয়!
ঠিক বলেছেন, স্যার, এর একটা বিহিত করা দরকার। ওদের জ্বালায় কোন মানুষ নিজের বাড়িতে শান্তিতে থাকতে পারবে না, তা কেন হবে?
রাস্তায় টহল দিতে বেরিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল ফগ। হুবারের বাড়িটা চোখে পড়তে মনে হলো একবার উঁকি মেরে দেখে যায়। তাই দেখতে এসেছে।
হুবারের সঙ্গে কিশোরকে দেখে ওর গোল চোখ আরও গোল গোল হয়ে গেল। হা হয়ে গেল মুখ। আবার নাক গলাতে এসেছে ওই বিন্দু ছেলেটা! ওর আগেই এসে বসে আছে। চিৎকার করে হুবারকে বলল, দরজাটা খুলুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
জ্বলন্ত চোখে ফগের দিকে তাকাল হুবার। গটমট করে গিয়ে জানালার শার্সি খুলে দিল। কি কথা? এ ভাবে উঁকি মারছেন কেন? দেখছেন না একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি? কি দরকার আপনার?
ঝামেলা! বন্ধু! ওর মত একটা ছেলে আপনার বন্ধু?
অপমান করে কথা বলছেন কেন? দাঁড়ান, হেড অফিসে গিয়ে আমি রিপোর্ট করব আপনার নামে। আমি চোর-ডাকাত নই, বেআইনী কিছুই করিনি যে পুলিস বারবার আমার বাড়িতে আসবে।
ঝামেলা!…ইয়ে, ঝামেলা! কথা হারিয়ে ফেলল ফগ। কাশি দিল। ইয়ে…আপনার বাড়িতে চোরের উপদ্রব হয়েছিল…
হয়েছিল তো আপনার কি? আপনাকে কে উপদ্রব করতে বলেছে?
অনেক কষ্টে হাসি চাপল কিশোর।
আপনার সামনের দরজা খোলা ছিল, কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করল ফগ। ভাবলাম…
কে ভাবতে বলেছে আপনাকে? ধমকে উঠল হুবার, যান, ভাঙন এখান থেকে!
আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করল কিশোরের। হুবারকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। চিরকাল ওদেরকে যাও ভাগো বলে ধমকে এসেছে ফগ, এখন কেমন মজা? নিজের শুনতে কেমন লাগছে।
রেগে গেল ফগ। আহ..ইয়ে…ঝামেলা! আপনি কোনও প্রাণীকে বাড়িতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফেলে যেতে পারেন না। সেটা অমানবিক। বেআইনী।
বেড়ালছানাটা ক্ষুধার্ত ছিল না! বলে ফগের মুখের ওপর শার্সিটা লাগিয়ে দিতে গেল হুবার।
চট করে রোমশ একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ঠেকাল ফগ। ছানাটা নাহয় ছিল না। কিন্তু কুকুরটা? শুয়োরটা?
ভুরু কুঁচকে ফগের দিকে তাকিয়ে রইল হুবার। কি বলছেন আপনি, কনস্টেবল? কিসের কুকুর? কিসের শুয়োর? পাগল হয়ে গেলেন নাকি?
পাগল, না? ঝামেলা! শুধু কুকুর আর শুয়োরের ডাকই শোনা যায়নি, একটা শিশুর কান্নাও শোনা গেছে এ বাড়িতে। চিৎকার করে ওর মাকে ডাকছিল।
হুবারের চেহারা দেখে মনে হলো, ফগ যে পাগল হয়ে গেছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার আর।
কিশোর ভাবল, এইই সুযোগ। ওরা দুজন কথা কাটাকাটি করতে থাক। সে গিয়ে ওপরতলাটা দেখে আসতে পারে। একটা মুহূর্ত দেরি করল না আর। বেড়ালছানাটাকে নিয়ে রওনা দিল সিঁড়ির দিকে। সঙ্গে নেয়ার কারণ–হুবার জিজ্ঞেস করলে ছুতো দেবে, তার কোল থেকে নেমে পালাচ্ছিল এটা, ধরার জন্যে সেও ছুটেছে পেছনে।
নিচতলায় ফগ আর হুবারের চিৎকার বেড়েছে। একটা কথা ভেবে কিশোরেরও অবাক লাগল, কুকুর, শুয়োর আর শিশুর কান্নার কথা কার কাছে শুনল ফগ? চুরি হওয়ার খবর শুনে ওরাও তো এসেছিল এ বাড়িতে। কই, বেড়ালছানাটা ছাড়া আর কোন জন্তু-জানোয়ার তো দেখেনি?
তবে কি কিটিকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল ফগ? লোকটাকে দেখতে পারে না বলে বানিয়ে বানিয়ে উল্টোপাল্টা বলে দিয়েছে কিটি?
হ্যাঁ, তাই হবে। মুচকি হাসল কিশোর।
ওপরতলার যে ঘরটায় ঢুকল সে প্রথম, সেটাও গোছগাছ করা। গুছিয়ে ফেলেছে হবার। ওর স্লিপার আর ড্রেসিং-গাউনটা খোঁজায় মন দিল সে।
.
০৯.
ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল কিশোর। একটা স্লিপারও চোখে পড়ল না। না না, আছে। একজোড়া লাল স্লিপার।
উল্টে দেখতে লাগল সে।
কাদা লাগা। প্রচুর কাদা। এগুলো পায়ে দিয়ে রাস্তায় হেঁটেছে হুবার, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
খাটের নিচ থেকে টেনে বের করল একটা লাল-সাদা পাজামা। ঠোঁট গোল করে শিস দিয়ে উঠল। পাজামার নিচের দিকটায় কাদামাখা। আপনমনে মাথা ঝকাল সে। এই কাদা কোথা থেকে এসেছে, ওর জানা।
নদীর কিনার থেকে।
এবার ড্রেসিং-গাউনটা দরকার। পাওয়া গেল ওটাও। একটা উঁচু আলমারির মধ্যে। ওটাও নোংরা। তবে তাতে কাদার বদলে খড়ের টুকরো লেগে আছে। ড্রেসিং-গাউনটা পরে কোথায় ঢুকেছিল হুবার?
আস্তে করে আলমারির দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর।
মোটেও বন্ধুর বাড়িতে যায়নি হুবার, ভাবল সে। বন্ধু কি আর তাকে খড়ের গাদায় শুতে দিয়েছিল নাকি। আসলে খড় আছে এমন কোনখানে ঢুকে লুকিয়েছিল সে। গোলাঘরে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাতে রাস্তাঘাট সব নির্জন হলে ওখান থেকে বেরিয়ে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এসেছে। চৌকিদার কি ফিরতে দেখেছে ওকে? তাহলে ভাববে আমার আঙ্কেল পম। হাহ হাহ!
নিচতলার গরম গরম কথাবার্তা থেমে গেল।
দড়াম করে একটা জানালা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। মেঝেতে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে ডাকতে আরম্ভ করল কিশোর, পুষি, পুষি, অ্যাই পুষি!
সিঁড়িতে একটা ডাক শোনা গেল, ওখানে কি করছ? জলদি নেমে এসো।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলল, সরি। বেড়ালছানাটা কোথায় জানি পালাল।
এই তো, নিচেই নেমে এসেছে, তপ্ত কণ্ঠে হুবার বলল। এবার তুমিও বেরোও। ছানাটাকে খাওয়ানোর জন্যে ধন্যবাদ। ওই নাকগলানো স্বভাবের পুলিসটাকে দেখে নেব আমি। ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট না করেছি তো আমার নাম হুবার নয়।