সাড়ে দশটার আগেই দোকানে ঢুকে বসে রইল ওরা। কিশোর এল কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে দশটায়। সঙ্গে রাফিয়ান। সাইকেল রেখে ঘরে ঢুকল। দরজায় থাকতেই বন্ধুদের ওপর চোখ পড়ল তার। হাসিমুখে এগিয়ে এল। জিনার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফিয়ান। আদর করে গালমুখ চেটে দিতে দিতে অস্থির করে তুলল।
বাড়িতে পেট পুরে নাস্তা করে এসেও হলিড়ে ইনে ঢুকে লোভ সামলাতে পারেনি মুসা। একগাদা কেকের অর্ডার দিয়েছে। কিশোর বসতেই প্লেটটা তার দিকে ঠেলে দিল, নাও।
না-রে, ভাই, হাত নাড়ল কিশোর, আমি খাব না। দেখছ না, আবার ফুলতে শুরু করেছি। ওজন বাড়লে বড় ঝামেলা!
কয়েক বছর আগে অনেক মোটা ছিল সে, একেবারে গোল। খাবারের লোভ তারও কম ছিল না। কিন্তু ডায়েট কন্ট্রোল আর প্রচুর ব্যায়াম করে করে অনেক কষ্টে ওজন কমিয়ে শরীরটা স্বাভাবিক করেছে।
আরে দূর, একটা টুকরো খেলে কিছু হবে না, মুসা বলল। খুব টেস্ট…
মাথা নাড়ল কিশোর, টেস্ট যে আমিও জানি। ঠিক আছে, ছোট এক কাপ আইসক্রীম খেতে পারি।
মুসাভাই, তুমি খাওয়ার গপ্পোটা একটু থামাও না, বাধা দিল ডল, সবার ছোট সে, বয়েস মাত্র আট, তাই কিশোর-মুসা-রবিন তিনজনকেই ভাই বলে ডাকে, জিনাকে জিনাআপু। কিশোরভাই, বলো, কি রহস্য পেয়েছ।
অবাক হলো কিশোর, রহস্য পেয়েছি কে বলল তোমাকে?
ফোনে বললে না জরুরী কথা আছে?
ও, সেটা! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। আর বোলা না, এবার কপালটা নেহাতই খারাপ আমাদের, গোবেল বীচে বেড়াতে এসেছিলাম! ইস, মেরিচাচী যখন বলল, কেন যে তার সঙ্গে গেলাম না!
ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাল জিনা, কেন, আবার কি হয়েছে? তুমি তো ভালই আছো, মার রান্না খাচ্ছো, স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াও, পড়তে হয় না… জেলখানায় তো রয়েছি আমরা…
সেই স্বাধীনতাটাই তো গেল বোধহয় এবার!
আরে এত ভণিতা না করে খুলেই বলে ফেলো না ছাই!
আগামী হপ্তায় একটা কনফারেন্স হতে যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই এক টুকরো কেক তুলে নিয়ে কামড় বসাল কিশোর।
তাতে কি?
তোমার বাবার একজন বন্ধুও তাতে যোগ দেবেন।
বিজ্ঞান-সম্মেলন হলে তাতে তো যোগ দেবেই পাগলগুলো। বাবা যেমন পাগল, তার বন্ধুগুলোও পাগল, বড় বড় উন্মাদ একেকটা; তাতে তোমার অসুবিধেটা কোথায়?
মিস্টার গ্রেগাবেবিরনকে চেনো?
নাম শুনেছি। দেখিনি। বাবার কাছে মাঝে মধ্যে চিঠি লেখে।
বাপরে, নাম কি!মুসা বলল, দিনের মধ্যে শখানেক বার কাউকে আউড়াতে দিলে দম আটকেই মরে যাবে। ঝামেলা র্যাম্পারকটকে দেয়া দরকার…
অত বড়টা বলার দরকার কি, জিনা বলল, ছোট করে নিলেই হয়, মা যেমন নিয়েছে। কথা উঠলে মা বাবাকে বলে তোমার বন্ধু মিস্টার গ্রেগ, অত্তবড় নাম বলতে যায় না।
সেটা অবশ্য সমস্যা না, আরও সহজ করে নেয়া যায়, মিস্টার বেবি বললেই হয়, কিশোর বলল। যা বলছিলাম, সেই মিস্টার গ্রেগাবেবিরন গোবেল বীচে কনফারেন্সে যোগ দিতে আসছেন। জিনার দিকে তাকাল সে, আর উঠছেন কোথায় জানো? তোমাদের বাড়িতে।
উঠুকগে, তাতেই বা তোমার কি? সারাক্ষণ বাবার ঘরেই বসে থাকবে। যন্ত্রণাটা হবে মার। কফির চালান দিতে দিতে আর বাবার ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জান যাবে। তোমার কিছু না?
আমার ঘাড়েও একখান যন্ত্রণা চাপানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই গ্রেগ ভদ্রলোক তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আসছেন সঙ্গে করে।
এতক্ষণে চোখ বড় বড় হলো জিনার। এলিজা! বাপরে, তাহলে তো বিপদ! শুনেছি ওটার ধারেকাছে নাকি শয়তানও ঘেষতে চায় না, এতই বিরক্তিকর। দুই বছর বয়েসে মা মরে যায়, তারপর মিস্টার গ্রেগই তাকে মানুষ করেছেন। তোমার ঘাড়ে চাপাল কি করে?
খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে মুসা। ডল আর রবিনও উৎসুক চোখে চেয়ে আছে কিশোরের দিকে।
দুই বিজ্ঞানী থাকবেন নিজেদের নিয়ে, কিশোর বলল, আইলিন আর কেরিআন্টি রান্নাঘর আর ঘর সামলানোর কাজে ব্যস্ত, মেহমান হয়ে আসা মেয়েটাকে তাহলে কে দেখবে? একা একা থাকতে নিশ্চয় খারাপ লাগবে তার। তাই নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর।
হেসে ফেলল মুসা, খুব খারাপ খবর। কিশোর, তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে আমার, যদিও সামান্যতম দুঃখের ছোঁয়া নেই তার কণ্ঠস্বরে। যেখানেই যাবে, ওই মেয়েটাও তোমার পিছে পিছে যাবে, দেখো, বলে দিলাম। সত্যি তুমি মরেছ।
সেটা জানি বলেই তো ভয়টা পাচ্ছি। স্বাধীনতা এক্কেবারে শেষ।
বাদ দাও বাড়িতে থাকাথাকি, হাত নাড়ল জিনা, বইপত্র নিয়ে পড়ালেখার ছুতোয় আমাদের কাছেই চলে এসো। এলিজার সঙ্গে বাড়িতে থাকার চেয়ে শান্তি।
এখানে আসার কথা বলিনি ভেবেছ। রেগে উঠলেন পারকার আঙ্কেল। কোন রকম চালাকি চলবে না, সাফ বলে দিয়েছেন তিনি। এলিজাকেই সঙ্গ দিতে হবে, কড়া নির্দেশ।
আল্লায় যা করে ভালর জন্যেই করে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। ভাগ্যিস রেজাল্ট খারাপ করেছিলাম। জোরে জোরে কেকের টুকরো চিবাতে শুরু করল সে।
হাতের টুকরোটা শেষ করে আনমনে আরেকটা টুকরো তুলে নিল কিশোর। কামড় বসাল তাতে। হঠাৎ খেয়াল করল কেক খাচ্ছে। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে নিজেই নিজেকে শাসাল, নাহ, আমি গাধারার শরীর কমবে না! এই রাফি, নে।
দৌড়ে এল রাফি। ওপর দিকে মুখ তুলে কিশোরের হাত থেকে ছেড়ে দেয়া কেকের টুকরোটা গাঁক করে দাঁতে চেপে ধরল। কোৎ করে গিলে ফেলল। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল আরও পাওয়ার আশায়।