চাকা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল সে। ওগলারা নেমে যাওয়ার সময় যদি ফাঁক করে রেখে গিয়ে থাকে, এই আশায়।
পা-দানী বেয়ে নামার শব্দ হলো। চট করে সরে গিয়ে ক্যারাভানের গায়ে মিশে। গেল আবার কিশোর। কে নামল? বুড়ি? নাকি অন্য লোকটা?
দেখতে পারল না ভাল করে। ওর দিকে পেছন করে হাঁটতে লাগল ছায়ামূর্তিটা। হারিয়ে গেল মাঠের অন্ধকারে। বাকি রইল আর একজন। হয় বুড়ি, নয়তো সেই চতুর্থ লোকটা। বুড়িই থাকবে, এত রাতে বেরোনোর কথা নয় তার। সেই লোকটাই বেরিয়েছে।
পা-দানীতে এসে উঠল সে। দরজায় ঠেলা দিল। লাগানো। তালা নেই নিশ্চয়। যা থাকে কপালে, খুলেই দেখবে। ভেতর থেকে বুড়ি দেখে ফেলে চেঁচামেচি শুরু করলে লাফিয়ে নেমে ঝেড়ে দেবে দৌড়। তবু ভেতরটা না দেখে যাবে না।
হাতল চেপে ধরে ঘোরাতে শুরু করল সে। ঘুরছে যখন, তারমানে তালা দেয়া নেই। পুরোটা ঘুরে যেতেই আস্তে করে ঠেলা দিল। ফাঁক হয়ে গেল পাল্লা।
ভেতরে উঁকি দিল। কাউকে দেখা গেল না। কোন শব্দও নেই। সাহস পেয়ে আরও ফাঁক করল। পুরোটাই খুলে ফেলল.শেষে।
কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। কেউ নেই ভেতরে। আশ্চর্য! ভূতুড়ে কাণ্ড নাকি? গেল কোথায় চার নম্বর লোকটী? তার অলক্ষে কোন ফাঁকে নেমে চলে গেল।
ছাত থেকে একটা লণ্ঠন ঝুলছে। প্রচুর আলো ভেতরে। কেউ থাকলে দেখা যেতই।
এতটাই অবাক হয়ে গেছে কিশোর, এ ভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলে যে অন্য ক্যারাভানের কেউ দেখে ফেলতে পারে, সন্দেহ করতে পারে, সেটাও ভুলে গেল। টনক নড়ল চিৎকার শুনে, এই, কে তুমি? ওখানে কি করছ?
ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর। একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে নিচে। কিশোর তাকাতেই কড়া গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করল না কিশোর। লাফ দিয়ে নেমেই দিল দৌড়।
চোর চোর বলে চিৎকার শুরু করল লোকটা। তার চেঁচামেচিতে ঝট ঝট করে খুলে গেল আরও কয়েকটা ক্যারাভানের দরজা। হাঁকডাক করে লোক ছুটে আসতে লাগল তাকে ধরার জন্যে।
মাঠ পেরিয়ে ওপাশের বনে ঢুকে যেতে পারলেই বেঁচে যেত, আর তাকে ধরতে পারত না, কিন্তু বাদ সাধল মাটিতে পড়ে থাকা একটা মরা ডাল। তাতে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। কপাল ঠুকে গেল শক্ত কিসে যেন। চোখের সামনে হাজারটা তারা জ্বলে উঠল। জ্ঞান হারাল না। তবে উঠতে দেরি করে ফেলল। ততক্ষণে চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ফেলল লোকেরা।
টানতে টানতে তাকে নিয়ে আসা হলো ওগলাদের ক্যারাভানের কাছে।
খবর শুনে ওগলা আর রাবুকা এসে হাজির। বুড়িও এল বিড়াল কোলে নিয়ে। কোথায় গিয়েছিল সে কে জানে। হাওয়া খেতে বোধহয়। টানাহেঁচড়ায় কিশোরের ছদ্মবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। লণ্ঠনের আলোয় দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ওগলা, কে রে তুই? সকালের সেই ছেলেটা না? তাই তো! গো, দেখো কি কাণ্ড! সকালেও এসেছিল ছদ্মবেশে, এখনও। ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। চোরের দলের পাই।
কাছে এসে দাঁড়াল বুড়ি। ভাল করে দেখতে লাগল কিশোরকে। আচমকা কিশোরের কানে ধ করে এক ঘুসি বসিয়ে দিয়ে বুড়ি বলল, পিটিয়ে তক্তা করে ফেলব! জলদি বল, কে তুই?
রাবুকাও কিলঘুসি মারতে শুরু করল।
ভয় পেয়ে বিড়ালটা লাফ দিয়ে নেমে গেল বুড়ির কোল থেকে। ছায়ার নিচে গিয়ে মিউ মিউ করতে লাগল।
যে লোকটা কিশোরকে উঁকি মারতে দেখেছিল, সে বাধা দিল। বলল, থাক, মারধরের দরকার নেই। সকালে পুলিশকে খবর দেব। যা করার ওরা করবে।
আরও পেটানোর ইচ্ছে ছিল রাবুকার। অন্যদের জন্যে পারল না। শেষে বলল, ঠিক আছে, বেঁধে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখি ভাঙা ক্যারাভানটার মধ্যে। সকালে পুলিশ এলে আরেক চোট ধোলাই হবে।
তা-ই করা হলো। ভাঙাচোরা খালি ক্যারাভানটার মধ্যে এনে ঢোকানো হলো তাকে। হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রেখে, দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল লোকগুলো।
টানাটানি করে দেখল কিশোর। সামান্যতম ঢিল করতে পারল না বাঁধন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। বুঝল, এই দুর্গন্ধে ভরা ক্যারাভানের মধ্যেই রাত কাটাতে হবে তাকে। বেকায়দা ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থেকে।
.
১২.
ভোরবেলা হই-চই শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। এত অসুবিধার মধ্যেও যে ঘুমাতে পারে মানুষ, নিজের বেলায়ই সেটা প্রমাণ হয়ে যেতে দেখে অবাক হলো।
ক্যারাভানের কাছে অনেক লোক এসে দাঁড়িয়েছে। তালা খোলার শব্দ হলো। খুলে গেল দরজা।
প্রথমেই ফগের ওপর চোখ পড়ল কিশোরের। দরজা খুলেছে যে লোকটা, তাকে সরিয়ে তার জায়গায় এসে দাঁড়াল ফগ। কিশোরকে দেখেই বলে উঠল, ঝামেলা! চিনতে পেরেও দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই বিন্দু ছেলেটাকে আশা করেনি। ফোনে ছদ্মবেশী চোর ধরা পড়ার খবর শুনে ভেবেছিল, সেই কয়েদীটাই ধরা পড়েছে। চোরটার বয়েস কত, সে-ও জিজ্ঞেস করেনি, যে ফোন করেছে সে-ও বলেনি।
কিশোরকে দেখে নিরাশই হলো ফগ। চুরি করতে যে আসেনি কিশোর, তারচেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। নিশ্চয় কয়েদীটাকে খুঁজতে এসেছিল। ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরেও লাভ হবে না। রিপোর্ট করতে হবে শেরিফের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুক্তি পেয়ে যাবে কিশোর। উল্টো হয়তো ধমক খেতে হবে তাকেই। তারচেয়ে এখানে ছেড়ে দিয়ে যাওয়াই ভাল।
কিশোরকে ছেড়ে দিতে বলল সে।