মাথা ঝাঁকাল প্রথম লোকটা। বুবুকার ছেলেমেয়ে দুটো ভীষণ পাজি। বুড়ি মা’টাকে জায়গা দিতে চায় না। খালি ঝগড়া করে। বুড়িও কম যায় না। শাপশাপান্ত করে আর গাল দিতে থাকে। কত মেলা হলো, কত লোক এল এই মাঠে ক্যারাভান নিয়ে থাকতে, ওদের মত জঘন্য পরিবার আর দেখিনি। গেলে বাঁচি।
অন্ধ জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, বুবুকা তোমার কিছু হতো নাকি? আত্মীয়?
না, বন্ধু ছিল। ছেলেমেয়েরা এখন হয়তো দেখলেও আমাকে চিনবে না।…চা’টার জন্যে ধন্যবাদ। খুব ভাল চা। বহুকাল এমন খাইনি।
খুশি হলো দুই ভাই। অন্ধ বলল, জিফি, রুটিটা কাট না। ওকেও একটু দে। রাতে আর বেশি লাগবে না আমাদের, হয়ে যাবে। কি বলিস?
দিচ্ছি।
না না, লাগবে না। চা খেয়েছি, তাতেই হবে। আজকাল রাতে কিছুই খাই না। খেলেই পেট খারাপ করে।
বুড়ো হওয়ার এই এক সমস্যা, আফসোস করে অন্ধ বলল। এক কাজ করো তাহলে। এখানে আমাদের সঙ্গেই থেকে যাও। এই রাতের বেলা কোথায় আবার খড়ের গাদা খুঁজতে যাবে।
না, না, তোমাদের আর কষ্ট দিতে চাই না। যেখানেই হোক, কাটিয়ে দেব রাতটা।
বাইরে মৃদু শব্দ হলো। কান খাড়া করল বুড়ো। নিশ্চয় বুড়ো বিড়ালটা। জিফি, দরজা খুলে দে। আসুক।
দরজা ফাঁক করতেই ভেতরে ঢুকে পড়ল হাড় জিরজিরে, লোম ওঠা একটা বুড়ো বিড়াল। একটা কান কামড়ে কেটে দিয়েছে অন্য বিড়ালে।
আপনার? বুড়োকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। এ তো মরে মরে। খাবার পায় না নাকি?
না, আমাদের না, একটা পিরিচে সামান্য একটু দুধ ঢেলে দিল জিফি। রাবুকাদের বিড়াল। নামেই ওদের, জীবনেও একটা দানা খেতে দিয়েছে কিনা সন্দেহ।
চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে বিড়ালটা। সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা বুদ্ধি মাথাচাড়া দিল কিশোরের মনে। বলল, রাবুকাদের ক্যারাভানে বরং নিয়ে যাই আমি এটাকে।
দুধ খাওয়া শেষ হলে বিড়ালটাকে তুলে নিল সে। বিড়াল দিয়ে আসার ছুতোয় ক্যারাভানের ভেতরটা দেখে নিতে পারবে।
দুই বুড়ো তাকে গুড-নাইট জানিয়ে বিদায় দিল। জিফি কিছুদূর এগিয়ে দেয়ার কথা বলল, রাজি হলো না কিশোর। বাইরে দাঁড়িয়ে হাত তুলে কোন ক্যারাভানটা রাবুকাদের, দেখিয়ে দিল জিফি। তারপর দরজা লাগিয়ে দিল।
কিশোর ভেবেছিল, ভাঙাচোরা হবে, কিন্তু বেশ বড় আর নতুন রাবুকাদের ক্যারাভানটা। মিউ মিউ করতে থাকা বিড়ালটাকে নিয়ে ওটার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বিড়ালের ডাক শুনে দরজা খুলে গেল। কে যেন ডাকল, পুষি, পুষি, কোথায় তুই? আয়।
গলাটা চেনা লাগল কিশোরের। ও কাছাকাছি হতে ক্যারাভানের পা-দানী বেয়ে নেমে এল একটা মূর্তি।
আপনার বিড়ালটা নিয়ে এলাম, কিশোর বলল। ওদিকে বসে বসে কাঁদছিল।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকায় কালো অস্পষ্ট মূর্তিটার চেহারা দেখতে পেল না কিশোর। আর দেখলেও তারার আবছা আলোয় চিনত কিনা সন্দেহ। টর্চ জ্বালল সে।
মিসেস বুবুকা। হাত বাড়াল বুড়ি, পুষি, পুষি, আয়। হতচ্ছাড়ি মেয়েটা দুচোখে বিড়াল দেখতে পারে না। রাতের বেলা রাস্তায় পড়ে মরার জন্যে ওগলা তোকে বের করে দিয়েছিল, তাই না? আহারে!
বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল বুড়ি।
ক্যারাভানে ঢোকার সুযোগ খুঁজছে কিশোর। গলা বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। দেখতে চাইছে, ওগলা আর তার ভাই ছাড়া আর কেউ রয়েছে কিনা ভেতরে।
বিড়ালটাকে এনে দেয়ার জন্যে কোন রকম সৌজন্য দেখাল না বুড়ি। ভেতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাল না কিশোরকে। বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে ঘুরে রওনা হলো ক্যারাভানের দিকে। পা-দানীতে উঠল। বুড়ির কাপড় যেমন পুরানো আর ময়লা, স্যান্ডেল জোড়াও তাই। কোথা থেকে ইয়া বড় বড় দুটো স্যান্ডেল কুড়িয়ে এনেছে কে জানে। ক্যারাভানে উঠে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত না দিয়ে দড়াম করে লাগিয়ে দিল দরজাটা। রাগ লাগল কিশোরের। ছেলেমেয়েরা যে দেখতে পারে না, এ জন্যেই। এ রকম চাষাড়ে স্বভাবের বুড়ীকে কে পছন্দ করবে।
অন্ধকারে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কিশোর। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। সামান্যতম ফাঁক পাওয়া গেলেই হতো। দেখে ফেলতে পারত ভেতরটা।
কিন্তু কোথাও কোন ফাঁক দেখতে পেল না। জানালাতে পর্দা টানা। নিরাশ হয়ে চাকা থেকে নামতে যাবে এই সময় নিচু গলায় তর্কাতর্কি শুরু করল দুজন লোক।
স্থির হয়ে গেল কিশোর। লোক! পুরুষ মানুষ! গলার স্বর বোঝা গেলেও, কথা বোঝা যাচ্ছে না। ওগলা আর তার মা মেয়েমানুষ। রাবুকা তর্ক করছে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে-তারমানে চতুর্থ কেউ রয়েছে ক্যারাভানে।
পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকিয়ে তারার আলোয় মাঠ ধরে একটা ছায়ামূর্তিকে এগিয়ে আসতে দেখল কিশোর। নামার সময় নেই আর এখন। চোখে পড়ে যেতে পারে লোকটার। যেখানে ছিল, সেখানেই চাকার ওপর দাঁড়িয়ে ক্যারভানের গায়ে গা লাগিয়ে মিশে থাকার চেষ্টা করল কিশোর।
দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক দিল লোকটা।
দরজা খুলে দিল ওগলা, কে?
আমি, পোকার। রাবুকাকে জিজ্ঞেস করো, ডার্ট খেলতে যাবে নাকি।
রাবুকা, পোকার ডাকছে, ওগলা বলল। আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। ক্যারাভানের মধ্যে গাদাগাদি করে থেকে দম আটকে আসছে আমার।
ক্যারাভান থেকে নামল দুই ভাই-বোন। কিশোরকে কেউ দেখল না। পোকার যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে শুরু করল তিনজনে। ক্যারাভানে রয়েছে এখন দুজন-বুড়ি আর চতুর্থ লোকটা, ভাবছে কিশোর। দেখতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু কি করে দেখবে?