আসব না মানে? যতদিন থাকব, রোজ আসব। এ রকম আলোচনা মিস করা যায়!
.
১১.
ডিনারের পর পারকার আঙ্কেল আর মিস্টার গ্রেগ গিয়ে ঢুকলেন স্টাডিতে। কখন বেরোবেন, কোন ঠিক নেই। কেরিআন্টি চলে গেলেন তার শোবার ঘরে। এলিজা গেল তার ঘরে। কিশোরের সঙ্গে আড্ডা দিতে চেয়েছিল, ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে তাকে ভাগিয়েছে কিশোর। আইলিন রান্নাঘরে খুটুর-খাটুর করছে। বেশিক্ষণ করবে না আর, বোঝা যায়।
নিজের ঘরে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে ছদ্মবেশ নিতে বসল কিশোর। অন্য কারও জন্যে বিশেষ ভয় নেই, তার ভয় এলিজাকে। রাতে বেরোনোর কথা শুনেছে। যদি এসে দরজার কাছে ঘাপটি মেরে থাকে?
মুচকি হাসল কিশোর। থাকো, যত পারো। ঘরের আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে দিল সে। দরজার কাছে এসে কান পাতল। কোন শব্দ নেই। এলিজা থাকলেও একেবারে নিঃশব্দ হয়ে আছে।
আস্তে করে জানালার পাল্লা খুলল কিশোর। চৌকাঠ ডিঙিয়ে শেডের ওপর দাঁড়িয়ে পাশে হাত বাড়াল। বৃষ্টির পানি নামার পাইপটা হাতে ঠেকতেই চেপে ধরল শক্ত করে। কোন রকম শব্দ না করে নেমে এল ওটা বেয়ে। রাফিয়ানের ঘরটা রয়েছে উল্টোদিকে। সে দেখতে পেল না ওকে। ডাকাডাকি করল না। নিরাপদেই বাগান পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল কিশোর। তারপর সোজা হনহন করে হাটা দিল। ফগ যদি টহলেও বেরিয়ে থাকে, তাকে দেখলে এখন চিনবে না। ভাববে, কোন বুড়ো মানুষ হাঁটতে বেরিয়েছে।
ক্যারাভানের মাঠে পৌঁছতে সময় লাগল না। ঠিকই বলেছে ওগলা, গিজগিজ করছে। গুণল। মোট বিশটা। কোনটা পুরানো, কোনটা নতুন। বেশিরভাগের ভেতরেই আলো জ্বলছে। রাবুকাদের কোনটা, কি করে জানবে?
উঁকি দিয়ে দেখা ছাড়া গতি নেই। দেখার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। সুতরাং বিপদের পরোয়া করল না। সামনে যে ক্যারাভানটা দেখল, সেটার চাকার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে ভেতরে তাকাল। দুজন মানুষ ভেতরে। একজন মহিলা, সেলাই করছে; আরেকজন পুরুষ, বই পড়ছে। স্বামী-স্ত্রী।
নেমে এসে পাশের আরেকটা নতুন ক্যারাভানের চাকায় চড়ল। একই ভাবে জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। নাহ, এটাতেও সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ল না। পর পর চারটা ক্যারাভান দেখল। পাঁচ নম্বরটার চাকার ওপর থেকে নেমে আসতেই কুকুরের ডাক শোনা গেল। কাছেই ঘেউ ঘেউ করছে ওটা। ওকে দেখে ফেলল নাকি? কুকুরটার কাছাকাছি কোন ক্যারাভানে ওঠার সাহস করল না আর। অনেকটা দূর দিয়ে ওটার পাশ কাটিয়ে মাঠের আরেকধারে চলল। ওদিকেও অনেকগুলো ক্যারাভান।
অনেক পুরানো, ভাঙাচোরা একটা ক্যারাভানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মাছির সার্কাসের তাবুটার কথা মনে পড়ল। ওটার করুণ দশার সঙ্গে এই ক্যারাভানটারও যেন মিল রয়েছে। ভেতরে আলোও জ্বলছে না।
পকেট থেকে টর্চ বের করল কিশোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে সাবধানে উঠে দাঁড়াল ক্যারাভানের চাকায়। জানালা দিয়ে দেখা সম্ভব হলো না। চাকা থেকে নেমে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। কান পেতে শুনল। কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আস্তে করে হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল দরজাটা। ভেতরে আলো ফেলল। খালি।
দূর! এ ভাবে হবে না! বিরক্ত হয়ে পড়ল সে। ওগলাদের ক্যারাভান কোটা, কারও কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে কিনা ভাবল।
খালি ক্যারাভানটার পাশের ক্যারাভানের কাছাকাছি এসেছে, অন্ধকার থেকে পুরুষকণ্ঠের হাক শোনা গেল, কে রে ওখানে?
বুড়ো মানুষ, বাবা, গলা কাঁপিয়ে জবাব দিল কিশোর। রাত কাটানোর জায়গা খুঁজছি। কাছাকাছি কোথাও খড়ের গাদা আছে, বাবা?
আছে তো, বলল লোকটা। কিন্তু যার গাদা, সেই চাষীটা মানুষ না। তোমাকে দেখলেই কুত্তা লেলিয়ে দেবে। দেখি অন্ধকার থেকে সরে এসো তো, চেহারাটা দেখি।
ক্যারাভানের দরজা খুলে গেল। লণ্ঠন হাতে উঁকি দিল এক প্রৌঢ়। এ অন্য আরেকজন। যে লোকটা কথা বলছিল, অন্ধকার থেকে সরে এসে সে দাঁড়াল ক্যারাভানের পা-দানীর কাছে। কিশোরও বেরিয়ে এল আলোয়।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো লোকটার। বলল, মনে হচ্ছে বহুকাল কিছু পেটে পড়েনি তোমার। এসো, এক কাপ চা খেয়ে যাও।
চোখে ভাল দেখে না এমন ভঙ্গিতে পা-দানী বেয়ে ওপরে উঠল কিশোর। পা রাখল ভেতরে। নিচে দাঁড়ানো লোকটাও উঠে এল। লণ্ঠন হাতে লোকটার চেয়ে। দুচার বছর কম হবে তার বয়েস।
ক্যারাভানের ভেতরে জিনিসপত্র নেই বললেই চলে। তবে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রথম লোকটা দ্বিতীয় লোকটাকে দেখিয়ে বলল, আমার ভাই। চোখে দেখে না। বসে বসে ঝুড়ি বানায়, হ্যাঁঙ্গার বানায়। আমি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি। পয়সাকড়ি নেই আমাদের। তবে তোমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারব।
আহ্, বড্ড দয়া তোমাদের, বলে মেঝেতেই বসে পড়ল কিশোর। অসুস্থ বুড়ো মানুষের মত ধুঁকতে লাগল।
মগে করে চা বানিয়ে আনল প্রথম লোকটা। তিনটে পুরানো কাপে ঢেলে দিল। চা খেতে খেতে বলল কিশোর, আসলে বুবুকাকে খুঁজতে এসেছিলাম আমি। শুনলাম, এখানেই আছে ওদের ক্যারাভান। অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে পেলাম না। তাই ভাবলাম, রাতটা কোন খড়ের গাদায় কাটিয়ে সকাল বেলা খুঁজে বের করব।
বুবুকাকে পাবে কোথায়? অন্ধ বলল। ও তো নাকি কোনকালে মরে গেছে। শুনলাম। ক্যারাভানটা ঢুকিয়েছে ওই ওদিকে, মাঠের দক্ষিণ কোনাটায়, তাই না রে, জিফি?