ও, আপনার মেয়েই দেখায়। তার নামই বুবুকা?
না, বুবুকা ছিল আমার স্বামী। মারা গেছে। আমার মেয়ের নাম ওগলা। ওর বাবা ওকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে কি করে মাছিকে দিয়ে কাজ করাতে হয়। বুদ্ধিমান প্রাণী এই মাছিগুলো। গায়েও ভীষণ জোর। দেখলে অবাক না হয়ে পারবে না। ভারসুদ্ধ যেভাবে গাড়ি টেনে নিয়ে যায়।
গাড়ি? মাছির গাড়ি বুঝি?।
সে তো বটেই। মাছি কি আর ঘোড়ার গাড়ি টানতে পারবে? নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল বুড়ি।
কিশোরের হাসি পেল না। আপনি তাহলে মিসেস বুবুকা?
স্বামীর নাম বুবুক হলে তাই তো হওয়ার কথা, আবার হাসল বুড়ি। আমি এখন আর কোন কাজ করতে পারি না। দেখাতে পারতাম আগে, এখন দেখাতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়। কি আর করব? ছেলেমেয়ের ওপর বসে বসে খেতে লজ্জা লাগে। তাই অন্যভাবে ওদের সাহায্য করি।
কাল শূটিং গ্যালারির সামনে আপনাকে টিকেট বিক্রি করতে দেখেছি।
ওটা আমার ছেলের গ্যালারি। ওগলার ভাই। রাবুকা। কাঁচের বাক্সটার দিকে তাকাল বুড়ি। হাত নাড়ল কিশোরের দিকে চেয়ে। দেখে যাও, গাড়িটাকে টানতে শুরু করেছে ওরা! কেমন গড়িয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট চাকাগুলো! খুব মজার, তাই না?…দাঁড়াও, আরেকটা খেলা দেখাচ্ছি তোমাকে। বাক্সের ডালা তুলতে হাত বাড়াল বুড়ি।
মা! আবার তুমি মাছির বাক্সের দিকে নজর দিয়েছ! পুরুষালী কণ্ঠের কর্কশ চিৎকারে কুঁকড়ে গেল বুড়ি।
কিশোর আর মিসেস বুবুকা, দুজনেই ফিরে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা চওড়া এক তরুণী। কালো চুল, চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ধারাল, চেহারা আর পোশাকেই বোঝা যায়, জিপসি। ধমকে উঠল বুড়ির দিকে চেয়ে, তোমাকে না। কতবার বলেছি, ওটাতে হাত দেবে না!
গলা শুনে মনে হয় পুরুষমানুষ কথা বলছে। কোন মেয়ের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। বুড়ির মেয়ে ওগলা, বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, এই চেহারা কোথায় দেখেছে? চেনা চেনা লাগছে কেন?
এই ফকিরের বাচ্চাটা কে? ঢুকতে দিলে কেন? কি না কি চুরি করে নিয়ে যায়! কিশোরের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, এই, কে রে তুইঃ মতলবটা কি?
মিনমিন করে জবাব দিল কিশোর, টম। খেতে পাই না, তাই একটা চাকরির আশায়…।
ভাল মানুষের কাছেই এসেছ চাকরির জন্যে! গজগজ করে বলতে লাগল। বুড়ি। আমাকেই দিনের মধ্যে বিশবার খেদায়। থাকব না, আমি থাকব না এখানে। অন্য কোথাও চাকরি খুঁজে নেব। কথায় কথায় এমন দুর্ব্যবহার…লাথি মারি অমন ছেলেমেয়ের মুখে!
যাও না, দেখি কে তোমাকে চাকরি দেয়? মুখ ঝামটা দিল ওগলা। এই ছেলে, বেরো! পারলে চড় মারে কিশোরকে। হাঁটতে হাঁটতে আবার রাবুকার আঁবুর কাছে চলে যাসনে! মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে ওর। সামনে পড়লে লাথি মারবে।
বাপরে বাপ, কি ভয়ানক পরিবার! বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল কিশোর, ডাক দিল ওগলা, এই ছেলে, শোন! ঘর ঝাড় দিতে পারবি?
ফিরে তাকাল কিশোর। ওগলার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কেন চেনা চেনা লাগছিল। ওর ভাই রাবুকার সঙ্গে অনেক মিল। শুটিং রেঞ্জে ছেলেটার পাশে যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছিল, সে-ই তাহলে রাবুক।
বুবুকার পরিবারটাকে অদ্ভুত লাগল কিশোরের। কি জানি কেন মনে হলো। এদের কাছে কয়েদীটার খোঁজ পাওয়া যাবে। ঘর ঝাড় দিতে রাজি হয়ে গেল। বলল, পারব।
পয়সা কিন্তু বেশি পাবি না, সাবধান করে দিল ওগলা। একবার ঝাড় দিলে পঁচিশ সেন্ট দেব।
দুদিন কিছু খাই না, মুখটাকে করুণ করে তুলল কিশোর, যা পাব তা-ই সই।
এত কমে রাজি হচ্ছে দেখে অবাক হলো ওগল। চুরি করবি না তো?
না, ম্যাম। বাপ-দাদা চোদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ চোর ছিল না আমার।
গোষ্ঠীর মধ্যে হয়তো তুইই প্রথম পেশাটা চালু করলি, বলা যায় কিছু ঠিক আছে, শুরু কর। ওই যে ওখানে ঝাড়।
ঝাড় দিতে দিতে তথ্য আদায়ের চেষ্টা চালাল কিশোর, ম্যাম, মিস্টার রাবুকার সঙ্গে আপনার চেহারার অনেক মিল।
হবেই। যমজ ভাই যে।
মায়ের সঙ্গে তেমন মিল নেই, চোখ ছাড়া।
মুখ বাকাল ওগলা। মাকে দুচোখে দেখতে পারে না, বোঝা গেল।
তাঁবুতে কোন বিছানা চোখে পড়ল না কিশোরের। এখানেই ঘুমান নাকি আপনারা? মাটিতে বিছানো মাদুর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সে।
ভিখিরির বাচ্চার কথা শোনো! এই গাধা, সারারাত মাটিতে পড়ে থাকা যায় নাকি? ক্যারাভান আছে আমাদের।
কই, মেলার আশেপাশে তো কোন ক্যারাভান দেখলাম না।
নতুন নাকিরে তুই এখানে? মেলার মাঠে ক্যায়াভান রাখার জায়গা আছে? নাকি রাখলে লোকে পছন্দ করবে? গাঁয়ের দক্ষিণে একটা ভোলা মাঠে আমাদের ক্যারাভান। আপনমনেই বকর বকর শুরু করল ওগলা, ওখানেও কি আর শান্তি আছে! ব্যাঙের পোনার মত লোক বাড়ছে। ক্যারাভানে ক্যারাভানে গিজগিজ। দম নেয়ার জো নেই। আচমকা কি মনে হতে ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোরের দিকে। এত প্রশ্ন করছিস কেন? নিশ্চয় চোরের দলের ছেলে! স্পাই! কোথায় কার কাছে মাল আছে, জানার জন্যে পাঠিয়েছে। এই ছোঁড়া, আর কে কে আছে তোর দলে?
সত্যি বলছি, ম্যাম, আমি চোর নই। মেলা আমার ভাল লাগে। মেলার। লোকজন, পশুপাখিও খুব ভাল লাগে, সেজন্যেই খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সার্কাসে যদি একটা চাকরি পেতাম, বাঘ-সিংহের খাঁচায় কাজ করতে বললেও আপত্তি করতাম না।