মাছির সার্কাস এসেছে মেলায়, জানতই না সে। বিজ্ঞাপনও দেয়নি ওরা। ঠিক করল, সকালে উঠেই দেখতে যাবে। ওই সময় শো থাকবে না, জানা কথা। তাতে বরং সুবিধেই হবে। কথা বলতে পারবে। কিভাবে দেখায় ওরা মাছির সার্কাস, জেনে আসবে। এই ছুতোয় দেখেও আসা যাবে লোকটা ওখানে রয়েছে কিনা।
কিন্তু যাবে কি করে? এলিজা তো সঙ্গে যেতে চাইবে। গেলেই ঝামেলা। পালানো ছাড়া গতি নেই। কেরিআন্টি বকবেন। তা বকুনগে। সেটা তো সে ফিরে আসার পর। ততক্ষণে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে তার।
অতএব পরদিন সকালে ছদ্মবেশ নিয়ে, এলিজাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে? সকালে দৌড়াতে বেরোয়নি। তক্কে তক্কে ছিল, কখন এলিজা রান্নাঘরে ঢোকে যেই ঢুকেছে, অমনি ড্রইংরুমের জানাল গলে সটকে পড়েছে। মেয়েটার। চোখে পড়েনি। পড়লে চিৎকার করে পাড়া জানাত।
রাফিয়ানকে সঙ্গে আনেনি কিশোর। নানার মানে তার ছদ্মবেশ ফাস করে। দেয়া। আপনমনে শিস দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলল।
পথে দেখা ফগের সঙ্গে। এই একটা ব্যাপার রীতিমত অবাক করে কিশোরকে। কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। যখনই সে ছদ্মবেশে কিংবা জরুরী কাজে বেরোয়, প্রায় সময়ই দেখা হয়ে যায় ফগের সঙ্গে। যেন আড়ালে থেকে ইচ্ছে করে কেউ দেখা করিয়ে দেয় ওদের।
সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে কিশোরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল ফগ। ঝামেলা! এই ভিখিরিটা আবার এল কোত্থেকে? নিশ্চয় পাশের গাঁ থেকে, ভাবল সে! ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই ছেলে, অ্যাই, নাম কি তোমার?
টম, স্যার। হাত বাড়াল কিলোর, দুদিন কিছু খাইনি, স্যার। একটা রুটি খাওয়ার পয়সা দেবেন?
ঝামেলা! দ্বিধা করল ফগ। পকেট হাতড়ে একটা পঞ্চাশ সেন্টের মুদ্রা বের করে কিশোরের হাতে ফেলে দিল। কড়া গলায় বলল, পয়সা দিলাম, কিনে খাওগে। খবরদার, কারও বাড়িতে চুরি করতে ঢুকবে না। ধরা পড়লে চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলব।
ফগের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর। তারপর রাস্তা থেকে নেমে। মাঠ পেরিয়ে কোনাকুনি এগোল। এই সকালবেলা ওকে সার্কাসে ঢুকতে দেখলে সন্দেহ করতে পারে ফগ। ওর চোখে পড়া চলবে না।
.
০৯.
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল কিশোর। মরে আছে যেন জায়গাটা। গত বিকেলের হই চইয়ের কোন চিহ্নই এখন নেই। ভাড়ের তাঁবুটার কাছে এসে দাঁড়াল।
বালতি হাতে পানি আনতে যাচ্ছে একটা ছেলে। কিশোরকে দেখে দাঁড়াল। কাউকে খুঁজছ?
ডক। ভাঁড় সাজে যে।
ও তো নেই। দাঁত তুলতে গেছে। ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল।
কখন ফিরবে?
তা তো বলতে পারব না। দাঁত তুলতে যতক্ষণ লাগে। দেখা করতে চাইলে বসতে হবে তোমাকে।
ছেলেটা চলে গেল। কিশোর বসে রইল। আধঘণ্টা পর এল ডক।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। ভাড়ের পোশাক নেই। সাধারণ প্যান্ট-শার্টে বড়ই সাদামাঠা লাগছে লোকটাকে। মাথায় ঘন চুল। চোখের দৃষ্টি এখন ঘোলা, যন্ত্রণার ছাপ। গালের একটা দিক ফুলে আছে, দাঁত ফেলে সে-জায়গাটায় ঠেসে তুলা ভরে দিয়েছেন ডাক্তার।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল লোকটা।
নাকের নিচে রঙ নেই এখন। ভালমত দেখা যায়। কোন রকম কাটা দাগ নেই। ওখানে।
এই ছেলে, কে তুমি? জিজ্ঞেস করল ডক। মুখে তুলা থাকায় কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে।
টম। একটা চাকরির আশায় এসেছিলাম।
লেখাপড়া জানো? হিসেব করতে পারবে?
ঘাড় কাত করল কিশোর, পারব।
তাহলে এসো। একটা পার্ট টাইম চাকরি তোমাকে দেয়া যেতে পারে। দাঁত। তুলে এসেছি আমি। এখন ওসব হিসেব-নিকেশ করতে পারব না।
ডকের চাকরিতে আর আগ্রহ নেই কিশোরের। যা দেখার দেখে নিয়েছে। বলল, পার্ট টাইম চাকরিতে হবে না আমার। দেখি, সারাক্ষণের জন্যে কেউ নেয় কিনা। দেখায় কারা, বলতে পারেন?
ওই যে ওদিকে গেলেই তাঁবুটা পাবে। কিন্তু ওরাও তোমাকে ফুল টাইম চাকরি দিতে পারবে না।
না দিলে আপনার কাছেই আসব।
এসো, বলে তাবুতে ঢুকে গেল লোকটা।
মাছির সার্কাসের তাবুটা খুঁজে পেল কিশোর। বড়ই জীর্ণ দশা। রঙ উঠে গেছে কাপড়ের। কয়েক জায়গায় তালি। তাবুর কানায় রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে :
বুবুকার বিখ্যাত মাছির সার্কাস
তাঁবুটার চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়, যতই বিখ্যাত বলে বিজ্ঞাপন। করুক, দেখার আগ্রহ নেই লোকের। ব্যবসা লি না।
আগের দিন চোখে পড়েনি কেন, বুঝতে পারল কিশোর। একে তো মাছি দেখার আগ্রহ নেই বলে লোকের ভিড় ছিল না, তার ওপর তাবুটা রয়েছে একেবারে শেষধারে, কয়েকটা স্টল আর আরও কয়েকটা তাবুর আড়ালে। এদিকে আসেইনি। ওরা। ফগের ওপর নজর ছিল বলে সে যেদিকে যেদিকে গেছে, ওরাও সেদিকেই থেকেছে।
তাবুর পর্দা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিল সে। এক বুড়ি বসে আছে। সেই বুড়িটা, গতকাল যাকে শূটিং রেঞ্জের সামনে টিকেট বেচতে দেখেছিল। একটা টেবিলে রাখা বড় কাঁচের বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর মনোযোগে।
কেমন আছেন, মা? কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর।
চমকে গেল বুড়ি। ফিরে তাকাল। মুখের ভাঁজগুলো গম্ভীর হলো। ময়লা শালের প্রান্তটা কাঁধের ওপর খসে পড়েছিল, মাথায় টেনে দিল আবার।
মাছির সার্কাস খুলবে কখন, বলতে পারেন? জানতে চাইল কিশোর।
সময় হলেই খুলবে, ফ্যাঁসফেঁসে শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল বুড়ি। খুকুর। খুকুর করে কাশল। আমার মেয়ে তো নেই এখন, সে এসে খুলতে