দেখি, হাত বাড়াল মূসা।
কিশোরও দেখল। একটা চিহ্ন পাওয়াতে আশা হলো ওদের, এদিক দিয়েই গেছেন হয়তো ক্যাপ্টেন। কাঁটাঝাড়ের পাশ কাটিয়ে এসে বুনোপথ ধরে প্রায় ছুটতে লাগল এখন তিনজনে।
আবার চিৎকার করে উঠল রবিন। সামনে পাথরের গা কেটে, উপত্যকার এপাশ থেকে ওপাশে বয়ে চলেছে একটা সরু নদী। নদীটার পাড়ে একটা ছোট খড়ির পাড়ে বসে পড়ল সে। তুলে আনছে কিছু।
মুসা আর কিশোর কাছাকাছি হলো তার।
কি পেয়েছে দেখাল রবিন। একটা দেশলাইয়ের বাক্স। ভেজা, কিন্তু। রঙটা তাজা। তারমানে বেশি সময় পড়ে থাকেনি পানিতে। আজ যেন রবিনেরই দিন। একের পর এক সূত্র চোখে পড়ছে তার।
দারুণ! কিশোর বলল, ক্যাপ্টেন যদি না-ও গিয়ে থাকেন, এ পথ দিয়ে যে একজন মানুষ গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নদীর পাড় ধরে হাঁটব। দেখি, আর কি পাই?
নরম মাটিতে পুরু হয়ে পড়ে আছে বাদামী পাইন নীড়ল, পা পড়লে দেবে। যায়, মনে হয় কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটছে। পায়ের ছাপ পড়ছে না। তারমানে এখানে মাটি ভেজা থাকলেও কারও ছাপ পাওয়ার আশা নেই। রাস্তা জুড়ে এক জায়গায় পড়ে আছে একটা গাছ। তার কাছে চকচকে একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল কিশোরের। ছুটে গেল সে। পাতার নিচ থেকে একটা নয়, দুটো চকচকে জিনিস বের করে আনল। শটগানের গুলির খোসা। শুকটুকে বলল, বারুদের গন্ধ আছে এখনও। যে-ই গুলি করে থাকুক, বেশি আগে করেনি।
কাপের আকৃতির দুটো গর্ত হয়ে আছে। একটাতে হাঁটু রেখে দেখল, খাপে খাপে বসে যায়। বলল, হাটু গেড়ে বসে গুলি করেছিল। ক্যাপ্টেন রিচটনের একটা বন্দুক গানর্যাকে নেই। তিনিও গুলি করে থাকতে পারেন। কিন্তু কাকে সই করে?
আমি কি জানি? হাত উল্টাল মুসা।
রবিন বলল, গরম হয়ে উঠছে কিন্তু ব্যাপারটা!
ওখানে আর কিছু পাওয়া গেল না। নদীর ধারের পথ ধরে এগোতে লাগল ওরা। কিছুদূর গিয়ে আবার বুনোগোলাপের ঝাড় পড়ল, পথের ওপর উঠে এসেছে, সেখানে আরেক টুকরো কাপড় পাওয়া গেল, প্রথম টুকরোটার মত। একই পোশাক থেকে ছিঁড়েছে। এ মাটিতে চোখ বোলাতে লাগল কিশোর। এক জায়গায় দেবে গেছে অনেকগুলো বিছুটি, কোন কোনটার গোড়া ভাঙা, ভারী কিছুর চাপে অমন হয়েছে।
খাইছে! বলতে বলতে নিচু হয়ে একটা টর্চ তুলে নিল মুসা। কাঁচটা ভাঙা। টুকরোগুলোও পাওয়া গেল ওখানেই। ক্যাপ্টেন রিচটনের, কোন সন্দেহ নেই! উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল সে। এই দেখো, তাঁর নামের আদ্যক্ষর লেখা রয়েছে, ডি আর!
বিছুটিগুলো ভাল করে দেখার জন্যে বসে পড়ল কিশোর। সিরিয়াস ব্যাপার, বুঝলে, পাতায় দেখো কিসের দাগ লেগে আছে!
রক্ত! উদ্বিগ্ন শোনাল রবিনের কণ্ঠ।
এই সময় একটা খসখস শোনা গেল! ঝট করে ফিরে তাকাল মুসা। দেখল, একটা পাথরের চাঙড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে আছে একটা মুখ। রোদেপোড়া বাদামী চামড়া, লম্বা লম্বা চুল, কালো উজ্জ্বল চোখের তারা কেমন বন্য করে তুলেছে চেহারাটাকে। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁট, বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে সে!
.
০৪.
একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেরা, যেন জ্বলন্ত ওই চোখজোড়া সম্মোহন করছে ওদের। তারপর হঠাৎ করেই পাথরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল মুখটা।
ডাইনী! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার মুখ। ওটাই খেয়েছে ক্যাপ্টেন রিটনকে! আমাদের পিছু নিয়েছিল! বললাম না, শব্দ শুনেছি।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, কিশোর। এখনও বেশিদূর যেতে পারেনি! জলদি এসো!
আগে আগে দৌড় দিল সে। তার পেছনে রবিন, সবশেষে মুসা। ছায়াঢাকা, প্রায় অন্ধকার বনের ভেতর দিয়ে ছুটল তিনজনে। আঁকাবাকা অচেনা পথ। কখনও সামনে পড়ছে গাছের নিচু ডাল, কখনও ঝোপঝাড়, কখনও কাঁটাঝাড়। ওগুলো এড়িয়ে চলতে গিয়ে নানা রকম কৎ করতে হচ্ছে।
সামনে ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে আসছে। হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল কেউ। থামল না গোয়েন্দারা। বন এক জায়গায় সামান্য হালকা, ওখানে এসে কিশোরের নজরে পড়ল, গাছের আড়ালে ঢুকে গেল গাঢ় বাদামী ফ্ল্যানেলের, ট্রাউজার আর সবুজ সোয়েটার পরা লম্বা একটা দেহ। বড় বড় গাছগুলোকে। পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটল।
ডাইনী না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। তবে ছুটতে পারে বটে!
মুসা ডাইনীর ভয়েই এগোচ্ছে না, নইলে হয়তো কাছাকাছি চলে যেতে পারত মানুষটার, কিন্তু কিশোর আর রবিন ওর সঙ্গে পারছে না। আচমকা বায়ে মোড় নিয়ে রাস্তা থেকে সরে ঘন বনে ঢুকে পড়ল সে। ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, বনে চলতে অভ্যস্ত।
চোখের আড়াল কোরো না! চিৎকার করে বলল কিশোর। পাহাড়ের কাছে গিয়ে কোণঠাসা করব ওকে!
কিন্তু গর্তের মত উপত্যকার গাছে ছাওয়া ঢালের কাছে পৌঁছেও থামল না। মানুষটা। গাছের শেকড়, ডাল, আর গোড়া ধরে ধরে দ্রুত উঠে চলল ঢাল বেয়ে।
কিন্তু অভ্যাস না থাকায় ওই পথে অত তাড়াতাড়ি উঠতে পারল না। গোয়েন্দারা। দূরত্ব বাড়ছে ক্রমেই।
দেয়ালের নিচের অর্ধেকটায় গাছপালা আছে, তার ওপরে ফাঁকা, শুধু। পাথর আর পাথর। ওখানে পৌঁছে খোলা জায়গায় বেরোতে হলো লোকটাকে। গায়ে রোদ পড়ল। থামল না সে। কোণাকোণি চলে, পাথরের। পর পাথর ডিঙিয়ে হারিয়ে গেল গর্তের ওপরে উঠে।
খোলা জায়গাটায় বেরিয়ে আর পারল না গোয়েন্দারা। পাথরের ওপর। বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল।