একটু পরেই চোখ মিটমিট করল রবিন। তাকাল টর্চের আলোর দিকে। দুর্বল কণ্ঠে বলল, আলো সরাও।…আরি, আমার কাপড় কি করেছ তোমরা? ন্যাংটো বানিয়ে ফেলেছ…
এখানে আমরাই কেবল, অসুবিধে নেই, হাসল কিশোর। নিজের অর্ধেক ভেজা শার্টটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও, এটা পরে ফেলো। এক্ষুণি কেবিনে ফিরে গিয়ে গা গরম না করলে মরবে দু-জনেই।
চিৎকারটা কে করল…
জাহান্নামে যাক চিৎকার! কাল সকালেও সেটা জানা যাবে। ওঠো, জলদি চলো।
সে-রাতে আর চিৎকার শোনা গেল না। সকালে সোনালি রোদ এসে পড়ল কেবিনের চারপাশে ঘাসের ওপর। তখনও নীরব রইল কেবিনটা। রাতের ধকলের পর নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
আরও অনেকক্ষণ পর রান্নাঘরে কেটলি আর বাসন-পেয়ালার টুংটাং শোনা গেল। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ডিমভাজা, প্যানকেক, আর কফির সুবাস।
একটা বাসন আর চামচ হাতে বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। বাসনটাকে ঘন্টার মত করে ধরে চামচ দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে ডাকল, অ্যাই আলসেরা, ওঠো। দশটা বাজে।
নড়েচড়ে উঠল ঘুমন্ত দুটো শরীর।
আঁউ। আমার মাথাটা গেছে! উঠে বসতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল রবিন। বজ্ঞো ব্যথা!…ক্যাপ্টেন এখনও ফেরেননি, তাই না?
না, শুধু আমি আছি, আর প্যানকেক, হেসে জবাব দিল কিশোর। সারাদিন খালিপেটে থাকতে না চাইলে জলদি উঠে এসো। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে আমার, একাই সাবাড় করে দেব দেরি করলে।
তার হুমকিতে রবিনের কিছু হলো না, কিন্তু বিছানায় তড়াক করে উঠে বসল মুসা। দৌড় দিল বাথরুমের দিকে।
খিদে তিনজনেরই পেয়েছে। রাতের ধকলই এর জন্যে দায়ী। রাক্ষসের মত গিলতে শুরু করল। খেয়েদেয়ে, তৈরি হয়ে আধঘন্টার মধ্যেই বেরিয়ে। পড়ল ক্যাপ্টেন রিটনকে খুঁজতে। মাথার যন্ত্রণা অনেক কমেছে রবিনের।
আগে আগে চলেছে কিশোর, গলায় ঝোলানো একটা শক্তিশালী দূরবীন। প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে পথটা নেমেছে একেবেকে। বড় বড় গাছপালার মধ্যে ঢুকতেই রোদ সরে গেল গা থেকে, পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। একটু আধটু যা নামছে, ব্যস। বিশাল সবুজ চাদোয়া তৈরি করেছে যেন গাছের মাখাগুলো। তবে দিনের বেলা তো এখন, যথেষ্ট আলো আছে বনের তলায়। ক্যাপ্টেন রিচটনের যাওয়ার চিহ্ন খুঁজতে খুঁজতে এগোল ওরা।
জায়গাটার নাম ব্ল্যাক হোলো কেন হয়েছে, বুঝতে পারছি, রবিন, বলল এত কালো একটা গর্তের নাম আর কি হবে?
চারপাশে পাহাড়ের দেয়াল, সহজে বাতাসও যেন ঢুকতে পারে না এখানে। অস্বাভাবিক নীরবতা। একটা পাতা কাপে না, কোন জানোয়ারের নড়াচড়া চোখে পড়ে না। রবিনের কথাটা এই স্তব্ধতার মাঝে বড় বেশি হয়ে কানে বাজল। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল মুসা। দাঁড়াও! কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করতে লাগল। চোখ ঘুরছে আশপাশের গাছপালার মধ্যে।
কাকের ডাক, রবিন বলল। মাইলখানেক।
নাহ, অন্য একটা শব্দ শুনলাম বলে মনে হলো।
সেই নালাটার কাছে এসে কাধ থেকে দড়ির বান্ডিল খুলে নিল মুসা। আজ আর বোকামি করল না কেউ, অসাবধান হলো না। মোটা গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে চলাচলের জন্যে একটা লাইফ-লাইন তৈরি করল।
নিরাপদে পার হয়ে এল অন্য পাড়ে। এগিয়ে চলল। পেছনে ফেলে এল পানির গর্জন। আবার ওদেরকে গিলে নিল যেন থমথমে নীরবতা।
আবার দাঁড়িয়ে গেল মুসা, দাঁড়াও!
কি শুনছ? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রবিন।
কি রকম একটা খসখসানি!
তুমিই করছ শব্দটা। জিনসের প্যান্টের পায়ে পায়ে ঘষা লাগছে…এসো। এ ভাবে বার বার থামতে হলে গর্তের তলায় আর নামতে পারব না।
এগিয়ে চলল ওরা। সন্তুষ্ট হতে পারল না মুসা। খুঁতখুতানি থেকেই গেল মনে।
দাঁড়াও? এবার থমকে গেল কিশোর।
তুমিও শুনেছ? জানতে চাইল মুসা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের বনের দিকে তাকাতে তাকাতে নিচু স্বরে বলল কিশোর, দেখিনি, তবে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ… কিছু একটা আমাদের পিছে পিছে আসছে।
তাহলে এখন কোথায় শব্দটা? রবিনের প্রশ্ন। আমরা থামলেই কি থেমে যায়? আমি তো কিছু শুনছি না!
আবার এগোল ওরা! আগে চলে এসেছে রবিন, কারণ কিশোর আর মুসা প্রতিটি ঝোপঝাড়, গাছের আড়ালে নজর রেখে চলেছে। কর অবশেষে শেষ হলো ঢাল। সমতল হলো পথটা। চলার গতি বেড়ে গেল। জোরে জোরে পা চালিয়ে চলল রবিন। কিছু বোঝার আগেই একটা কাঁটা ডালে আটকে গেল প্যান্ট। খুদে খুদে কাঁটা কাপড় ফুটো করে খোঁচা দিতে লাগল চামড়ায়। নিচু হয়ে সেটা ছাড়াতে যেতেই অন্য ডালের কাটায় আটকে গেল সোয়েটারের পিঠ, হাতা, হাতের খোলা চামড়ায়ও খোঁচা লাগল! একটা ছাড়াতে গেলে আরও দশটা বিঁধে যায়।
পেছন থেকে হেসে বলল কিশোর, বনগোলাপের কাঁটা, তাড়াহুড়ো করলে আরও আটকে যাবে। খুব আস্তে আস্তে ছাড়াও, একটা একটা করে।
কিশোরের পরামর্শে কাজ করে কাঁটার ফাঁদ থেকে মুক্ত হলো রবিন। তবে বেশ কিছু খোঁচা সহ্য করার পর। সতর্ক হয়ে এগোল, আর আটকাতে চায় না। কিন্তু কয়েক পা এগোতে এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হলো। কিশোর! মুসা!
কি হলো? আবার আটকেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হাসিমুখে ফিরে তাকাল রবিন। আমাকেও শুধু বোকা বানায়নি ওই কাঁটা, আরও একজনকে বানিয়েছে। হাত বাড়িয়ে কাঁটা থেকে একটুকরো ছেঁড়া কাপড় খুলে আনল সে। উজ্জ্বল রঙ, চেককাটা ছাপ। দেখো। শার্ট ছেঁড়া। ক্যাপ্টেনেরও হতে পারে। পুরানো নয়, তাহলে রঙ চটে যেত।