ক্যালেন্ডারটা হাতে নিল রবিন। আরও কয়েকটা কুকুরের নাম দেখল বিভিন্ন তারিখের নিচে। একটা তারিখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। এটা দেখেছ। লিখেছেন: চিৎকার শুনলাম!
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
বাসন ধুতে ধুতে ফিরে তাকাল মূসা, বাহ; চিৎকারটা তাহলে ক্যাপ্টেনও শুনেছেন! আর তো হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না!
ঠিকই বলেছ। একজন পুলিশ অফিসার, ভালমত না শুনলে লিখতেন, কিশোর বল। আনমনে বিড়বিড় করল, চিৎকার শুনেছেন, কুকুরের কথা লিখেছেন: লোকে বলে ডাইনীটা চিৎকার করে, কুকুরও ধরে নিয়ে। যায়…
পটির কথা লিখেছেন নাকি দেখো তো?
দ্রুত দেখে নিল রবিন। না। এটা মাত্র কাল রাতের ঘটনা। না লেখার আরেকটা মানে হতে পারে, তিনি এখানে তখন ছিলেন না, হয়তো আজ সারাদিনেও ফেরেননি।
হতে পারে, একমত হলো কিশোর। আমি এখন আরও শিওর হচ্ছি, বিপদেই পড়েছেন তিনি। কাল সকালে উঠেই তাকে খুঁজতে বেরোব।
আমার কাজ শেষ, টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল মূসা। হাই তুলতে তুলতে বলল, রাতে নিশ্চয় আর কিছু করবে না। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। বাংকে কে শোবে? দাঁড়াও, টস করে নিই।
টসফস লাগবে না, হেসে বলল রবিন। ইচ্ছে হলে তুমি ঘুমাওগে। আমি আর কিশোর মেঝেতেই শুতে পারব, স্লীপিং ব্যাগে।
মৃদু একটানা হিসসস আওয়াজ করে জ্বলছে হ্যাজাক লাইট। আলো জ্বেলে রাখা প্রয়োজন মনে করল না কিশোর। চাবি ঘুরিয়ে তেল বন্ধ করে দিল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কমলা রঙ হয়ে রইল ম্যানটেলটা, তারপর নিভে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল কেবিন। একেবারে নীরব হয়ে গেল। অনেক পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছে ওরা, তারপর বনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম।
মাঝরাতে ভয়াবহ একটা শব্দে চমকে জেগে গেল তিনজনেই। চোখ মেলে, কান পেতে চুপ করে পড়ে রইল অন্ধকারে, আরেকবার শব্দটা শোনার আশায়।
শোনা গেল আবার। রাতের নীরবতা খান খান করে দিল তীক্ষ্ণ, তীব্র চিৎকার, যেন ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল কোন মহিলা। কেবিনের পেছনে গর্তের নিচ থেকে এল বলে মনে হলো।
চিৎকারটা মিলিয়ে গেলে ফিসফিস করে মুসা বলল, ক্যাপ্টেন কাল এই চিৎকার শুনেই দেখতে যাননি তো?
জানি না, লাফিয়ে উঠে বসল কিশোর। মনে হয় কেউ বিপদে পড়েছে। এই, জলদি কাপড় পরে নাও, দেখতে যাব।
দুই মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সন্ধ্যায় যে বুনোপথটা দেখে এসেছে কিশোর, সেটা ধরে দৌড়ে নেমে চলল উপত্যকায়। ঘন ঝোপঝাড় আর বড় বড় পাথরে পড়ে বিচিত্র ছায়া সৃষ্টি করছে টর্চের আলো,। একে তো অচেনা পথ, তার ওপর বেরিয়ে থাকা গাছের শেকড় বাধা দিয়ে গতি কমিয়ে দিচ্ছে।
কাউকে চোখে পড়ল না ওদের। একটা জায়গায় এসে থেমে দাঁড়াতে হলো। সামনে একটা পাহাড়ী নালা। পাথরে পাথরে বাড়ি খেয়ে যেন টগবগ করে ফুটতে ফুটতে, সাদা ফেনা তৈরি করে তীব্র গতিতে বয়ে যাচ্ছে স্রোত।
তখন এই পর্যন্ত এসেই ফিরে গেছি, পানির প্রচণ্ড শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল কিশোর। পেরোবে নাকি?
নিশ্চয়, বলেই বোকার মত পানিতে পা দিয়ে বসল রবিন। কিন্তু। স্রোতের শক্তি আন্দাজ করতে পারেনি সে, একটানে তাকে চিৎ করে ফেলল। নিজেকে সামলানোরও সময় পেল না। নিতান্তই একটা খড়কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে চলল তাকে পানি।
.
০৩.
আলো সরাবে না! চিৎকার করে বলল কিশোর। ধরে রাখো!
রবিনের ওপর টর্চের আলো ধরে রেখে পাড় ধরে নিচের দিকে দৌড়ে নামতে লাগল দুজনে।
জবাব না দিয়ে তার টর্চটাও কিশোরের হাতে গুঁজে দিয়ে ওই স্রোতের মধ্যে নেমে গেল মুসা। বরফের মত শীতল পানি, কিন্তু গভীরতা বেশি নয়। উঠে দাঁড়াল সে, পানি বেশি না এখানে, মাত্র কোমর পানি, কিন্তু সাংঘাতিক টান, পেছন থেকে ঠেলা মেরে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।
প্রায় বেহুশ হয়ে গেছে ততক্ষণে রবিন। নিচে নেমে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো। করে যে নেমে যাবে মুসা, তার উপায় নেই। নালার নিচটা খুব পিচ্ছিল। পা রাখাই মুশকিল। নিজেকে বোঝাল, উল্টে পড়ে বিপদ আরও বাড়ানোর চেয়ে আস্তে নামাই ভাল।
কিশোরের হাতের দুটো টর্চের আলোয় পথ দেখে দেখে রবিনের কাছে পৌঁছে গেল সে। একটা পাথরে ঠেকে আটকে আছে রবিন। বেহুঁশ। নাকটা কেবল রয়েছে পানির ওপরে।
পা দুটো একটা খাঁজে শক্ত করে আটকে দিল মুসা, যাতে পিছলে না পড়ে। উবু হয়ে পাজাকোলা করে তুলে নিল রবিনকে। আগুন লাগলে দমকল কর্মীরা যে ভাবে কাঁধে তুলে নেয় আক্রান্ত মানুষকে, সে-ও তেমন করে কাঁধে ফেলল অচেতন দেহটাকে।
এদিক দিয়ে উঠে এসো! আলো ফেলে পথ দেখিয়ে চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠে আসতে লাগল মুসা। কাঁধে বোঝা নিয়ে এখন পা পিছলালে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তবে আর কোন অঘটন ঘটল না। তীরে উঠে রবিনকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে বসে হাঁপাতে লাগল সে।
চোখের পলকে রবিনের ওপর এসে ঝুঁকে বসল কিশোর। অবস্থা কতটা গুরুতর দেখতে শুরু করল। নাড়ি দেখল, ঠিকই আছে। নিজের গা থেকে শার্ট খুলে নিয়ে ওটাকেই তোয়ালে বানিয়ে মুখ থেকে পানি মুছতে লাগল।
টর্চের আলোয় মাথায় একটা জখম চোখে পড়ল, রক্ত বেরোচ্ছে, পাথরে। বাড়ি খেয়ে হয়েছে ওটা। টেনে টেনে রবিনের ভেজা জামাকাপড় খুলে ফেলল সে। ভেজা গা মুছিয়ে দিল।