মেঝেতে পানি এল কোত্থেকে? রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। এ রকম হওয়ার কথা নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন ক্যাপ্টেন। পানি পড়লে সঙ্গে সঙ্গে মুছে ফেলার কথা।
নুয়ে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল কিশোর। বরফের মত শীতল। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল এককোণে রাখা একটা পুরানো আমলের আইস-বক্সের কাছে। নিচ থেকে টেনে বের করল একটা বেসিন, পানিতে টইটম্বুর, ওটা থেকেই পানি উপচে পড়ে মেঝে ভাসিয়েছে।
দুই সহকারীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল সে, বরফ গলে এই পানি। জমেছে।
ভুরু কুঁচকে বলল রবিন, জমতে তো অনেক সময় লেগেছে নিশ্চয়। পরিষ্কার করলেন না কেন ক্যাপ্টেন?
বেসিনের পানিটা সিংকে ঢেলে খালি করল কিশোর। বিড়বিড় করল, ব্যাপারটা অদ্ভুত!
মুসা বলল, মানুষ তো আর সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে না। হয়তো তিনি। যাওয়ার পর পড়েছে।
বিছানাটাও এলোমলো, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। বাইরে গেলে এ ভাবে ফেলে যাওয়ার কথা নয়। যে রকম গোছগাছ করা স্বভাব তার, গুছিয়েই রেখে যেতেন। পানি নাহয় পরে পড়তে পারে, কিন্তু বিছানাটা তো আর। আপনাআপনি অগোছাল হতে পারে না।
হয়তো তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন, অনুমান করল মুসা। গোছানোর সময় পাননি?
তাহলে কি এমন কাজে চলে গেলেন, যে বিছানা গোছানোরও সময় পাননি? নিজেকেই প্রশ্নটা করল যেন কিশোর।
ব্যাপারটা খাপছাড়া লাগল গোয়েন্দাদের কাছে। বেরিয়ে এসে বাটির মত জায়গাটার কিনারে দাঁড়াল, যেখান থেকে উপত্যকায় নেমে গেছে ঢাল। মুখের কাছে হাত জড় করে চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন রিচটন! ক্যাপ্টেন রিচটন!
জবাবের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কিন্তু কোন সাড়া এল না বিরাট কালো গর্তটা থেকে, এমনকি কোন প্রতিধ্বনিও নয়।
গুরুতর কিছু একটা হয়েছে মনে হয়, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলা যায় না, কোথাও জখম হয়েও পড়ে থাকতে পারেন। খুঁজতে যাব। একপাশের জঙ্গল দেখিয়ে বলল, মুসা, তুমি আর রবিন ওদিকে যাও, আমি এদিকে যাচ্ছি।
বনে ঢুকে পড়ল দুই সহকারী গোয়েন্দা। অনেক বড় বড় গাছের মাথা এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে, রোদ আটকে ফেলে, গোড়ায় আগাছা জন্মাতে দেয় না। ফলে হাঁটা সহজ। গোধূলির কালচে-ধূসর ছায়া নেমেছে বনতলে, আর আধঘণ্টার মধ্যেই পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর মুসা বলল, রাত তো হয়েই গেল। আর খুঁজে লাভ নেই। চলো, ফিরে যাই।
আবার খোলা জায়গাটায় ফিরে এল দু-জনে। কিশোরের নাম ধরে ডাকল মুসা। জবাব পেল না।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল সে, এ-কি ভূতুড়ে কাণ্ড! প্রথমে ক্যাপ্টেন, এখন কিশোরও গায়েব…
খসখস শব্দ শুনে থেমে গেল সে।
শশশ! ফিসফিস করে বলল রবিন, কিসের শব্দ?
খোলা জায়গাটায়ও এখন অন্ধকার। বনের ভেতরে আবার শোনা গেল শব্দটা, নড়ছে যেন কিছু। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে।
মুসা? রবিন? ডাক শোনা গেল বনের কিনার থেকে।
ও, কিশোর! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা।
কাছে এসে জানাল কিশোর, কোন চিহ্নই পেলাম না ক্যাপ্টেনের। উপত্যকায় নামার একটা পথ পেয়েছি। ওটা ধরে এগিয়েছিও কিছুদূর। এ জন্যেই দেরি হয়েছে। কিন্তু কিছু পেলাম না।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল রবিন। এক রহস্যের কিনারা করতে এসে আরেক রহস্য…চলো, আমাদের মালপত্রগুলো ভেতরে নিয়ে যাই। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।
.
খানিক পরেই ছোট্ট কেবিনের রান্নাঘর থেকে মাংস আর ডিমভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। খেতে বসে গেল তিন গোয়েন্দা। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। রিচটনের উধাও হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে তিনজনে।
ঘরের দরজায় তালা নেই, গাড়িটাও রয়েছে, নিজেকেই যেন বোঝাল কিশোর, দুটো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ, মাথা ঝকাল রবিন। হয় কেউ তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে, নয়তো তিনি নিজেই হেঁটে গেছেন। এত তাড়াহুড়া করে গেছেন, দরজায় তালা লাগানোরও সময় পাননি। হেঁটে গেলে এমন কোন জায়গায় গেছেন, যেখানে গাড়ি চলে না।
ওরকম জায়গা একটাই দেখেছি। গর্তের মত উপত্যকাটা, ব্ল্যাক হোলো।
প্লেটের খাবার চেটেপুটে শেষ করে ফেলল মুসা। রহস্য নিয়ে যত খুশি মাথা ঘামাও তোমরা, সূত্র খুঁজতে থাকো, আমি এই সুযোগে বাসন পেয়ালাগুলো ধুয়ে ফেলি। তারপর আরও কাজ আছে। তবে সেগুলো করতে পারি এক শর্তে।
কী? কিছুটা অবাক হয়েই জানতে চাইল কিশোর।
কিছু লাকড়ি এনে দিতে হবে।
মুসার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন, ভেবেছিল কি না জানি বলবে। উঠে গেল রিচটনের জড় করে রাখা লাকডির স্তূপ থেকে লাকডি আনার জন্যে। ফিরে এল দু-জনে দুই বোঝা নিয়ে।
হ্যান্ডপাম্পটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুসা। বসে না থেকে ঘরের ভেতরে খুঁজতে শুরু করল অন্য দু-জনে–কি খুঁজছে জানে না, তবে ক্যাপ্টেনের উধাও হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু।
কিশোর, লিভিংরুম থেকে ডাকল রবিন। গানরাকে একটা বন্দুক কম। রাইফেলও হতে পারে সেটা, কিংবা শটগান। জায়গাটা খালি।
রান্নাঘরের টেরিলে আরও মূল্যবান একটা সূত্র খুঁজে পেল কিশোর। ডাকল, রবিন, দেখে যাও।
রান্নাঘরে দৌড়ে এল রবিন।
টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া বুকসাইজ ক্যালেন্ডারটা দেখাল কিশোর। গত দুই মাসের তারিখগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার। একটা বিশেষ তারিখের নিচের লেখা দেখিয়ে বলল, এই যে দেখো, কোন জাতের কুকুর, মালিকের নাম, পরিষ্কার করে লিখেছেন। জুনের দশ, বর্ডার টেরিয়ার, মালিকের নাম জন হিগিনস।