ধীরে ধীরে ওটাকে পেছনের দরজাটার কাছে নিয়ে গেল কিশোর। জানোয়ারটার ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ না সরিয়ে মুসাকে বলল, এই দরজাটাও তোলো।..
সবে অর্ধেক উঠেছে দরজাটা, এই সময় চিৎকার শোনা গেল পেছনে। পুমার চিৎকার আর শেকলের শব্দ কানে গেছে ডোবারের, দেখতে এসেছে কি হয়েছে। চেপে ধরল মুসাকে।
পেছনে তাকাল না কিশোর, ঝটকা দিয়ে মশালটা বাড়িয়ে দিল পুমার দিকে। গর্জন করে পিছিয়ে গেল ওটা, খোলা দরজা দিয়ে চলে গেল সুড়ঙ্গমুখে। আগুনের ভয় ক্ষুব্ধ করে তুলেছে ওটাকে। সাহস সঞ্চয় করে থাবা তুলল কিশোরকে মারার জন্যে।
মরিয়া হয়ে ওটার হাঁ করা মুখে মশালটা ঠেসে ধরল কিশোর।
পুরোপুরি সাহস হারাল পুমাটা। আগুনের আঁচে ঝলসে গেছে মুখ। বিকট চিৎকার করে একলাফে ঘুরে দাঁড়িয়ে দিল দৌড়। হারিয়ে গেল সুড়ঙ্গের অন্ধকারে। মশাল হাতে কিশোরও ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠে তার পিছু নিল ফেরেল।
বেশি লম্বা না সুড়ঙ্গটা। অল্পক্ষণেই বেরিয়ে চলে এল কিশোর। পুমাটাকে চোখে পড়ল না কোথাও। বনে ঢুকে পড়েছে।
কিশোরও ঢুকে পড়ল। হাতে যতক্ষণ আগুন আছে, জানোয়ারটাকে ভয় নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারল না ওটা। পিস্তলের গুলি ফুটল টাশশ করে। কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। মশালটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে ডাইভ দিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে পড়ল সে।
ছুটে আসছে পদশব্দ। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল সে। গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটতে লাগল। আরেকবার গুলি হলো পেছনে। তার হাতখানেক তফাতে গাছের গায়ে বিধল বুলেট। গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। ছুটতে ছুটতে চলে এল পাথরের ঢালের কাছে। থমকে দাঁড়াল। মুহূর্ত পরেই তার পাশের দেয়াল থেকে চলটা তুলে দিয়ে বিইঙ করে চলে গেল বুলেট।
ঢাল বেয়ে উঠতে গেলে গুলি খাবে, খোলা জায়গায় তাকে মিস করবে না ফেরেল। আর কোন উপায় না দেখে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কিশোর।
ভোর হয়ে আসছে। ধূসর আলোয় পা টিপে টিপে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। যে রকম বিশালদেহী, খালি হাতে এলেও তার সঙ্গে পারত না সে, তার ওপর হাতে রয়েছে পিস্তল। আত্মসমর্পণ না করলে গুলি খেতে হবে।
পাথরটার কাছে চলে এসেছে ফেরেল। হাত তুলে বেরিয়ে আসবে কিনা ভাবছে কিশোর, এই সময় উড়ে এল একটা পাথর। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ, এই অল্প আলোতেও একটু এদিক ওদিক হলো না, ঠিক এসে ফেরেলের হাতের পিস্তলে লাগল ওটা। হাত থেকে খসে পাথরে পড়ল পিস্তলটা, গড়িয়ে চলে গেল কয়েক হাত। পরমুহূর্তে ওপর থেকে উড়ে এল একটা দেহ, ফেরেলকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
পিচার! চিৎকার করে উঠল কিশোর। তুমি কোত্থেকে…
কিন্তু জবাব দিতে পারল না বোবা ছেলেটা। কিশোরের দিকে তাকানোরও সময় নেই। ধস্তাধস্তি শুরু করছে লোকটার সঙ্গে। বেশিক্ষণ যুঝতে পারবে না সে, বোঝাই যাচ্ছে। যা করার তা-ই করল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলে নিল ফেরেলের পিস্তলটা। অপেক্ষা করতে লাগল।
পিচারের বুকের ওপর উঠে এল ফেরেল। দু-হাতে গলা টিপে ধরে ছেলেটাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার চেষ্টা করল।
তার মাথার পেছনে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে ধমকে উঠল কিশোর, খবরদার!
ফিরে তাকাল ফেরেল। থামল না। কিশোর যে গুলি করবে না এটা বুঝে হাত বাড়াল ধরার জন্যে। যা থাকে কপালে ভেবে পিস্তনটা তুলে গায়ের জোরে লোকটার চাদিতে বসিয়ে দিল কিশোর।
টুঁ শব্দ করল না ফেরেল। আস্তে ঢলে পড়ে গেল পিচারের গায়ের ওপর।
ঠিক এই সময় দুপদাপ করে একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, পড়িমরি করে দৌড় দিয়েছে ডোবার, ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পালাচ্ছে। দেয়ালের কাছে পৌঁছেও থামল না, বেয়ে উঠতে শুরু করল।
কেন পালাচ্ছে বুঝতে পারল না কিশোর। বোঝার চেষ্টাও করল না, চেঁচিয়ে বলল, পিচার, জলদি ওটাকেও পালাতে দেয়া যাবে না! বলে সে ও পিছু নিল ডোবারের।
হরিণের গতিতে কিশোরের পাশ কাটাল পিচার। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল।
কিশোরও বসে রইল না, তবে পিচারের তুলনায় তার ওঠাটাকে শামুকের গতিই বলা চলে।
একটা শৈলশিরায় পৌঁছে পেছন ফিরে তাকাল ডোবার। দেখল, বোবা ছেলেটাও পৌঁছে গেছে। তাকে ঘুসি মারার জন্যে হাত তুলল সে।
একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল! ডোবারের পা সই করে ডাইভ দিল পিচার। তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল চ্যাপ্টা পাথরের ওপর। অনেক ওপরে। শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণেই উড়ে এল দুশো পাউন্ড ওজনের। একটা ভারী শরীর। ডোবার আর পিচারের ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল, পড়ল গিয়ে কয়েক গজ নিচের পাথরে। উঠে দাঁড়ানোর সাধ্য হলো না আর পুটার, গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে। ডোবারকে সই করেই ঝাঁপ দিয়েছিল ওটা। ওই মুহূর্তে পিচার তাকে ফেলে না দিলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেত আরিগনদের বংশধর।
ঘটনাটা স্তব্ধ করে দিল ডোবারকে। উঠে বসল কোনমতে, থরথর করে কাঁপছে। পালানোর চেষ্টা করল না আর, ক্ষমতাই নেই যেন শরীরের।
শৈলশিরায় পৌঁছে গেল কিশোর। পিস্তল তাক করল ডোবারের দিকে। কিন্তু তার দিকে নজর নেই লোকটার, তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পরাজিত ভঙ্গি।
এতক্ষণে হই-হট্টগোল খেয়াল করল কিশোর। ফর্সা হয়ে গেছে পুবের আকাশ। নিচে তাকিয়ে দেখল সে, অনেক পুলিশ। জাল দিয়ে আটকে ফেলেছে পুমাটাকে।