হে আমরাও বিশ্বাস করিনি একথা। বরং বলে তার ওপর আমাদের সন্দেহ জাগিয়েছে।
পেঁচার ডাকটা যে আসলে পেঁচার নয়, মানুষই ওরকম করে ডেকে সঙ্কেত দেয়, তার এই সন্দেহের কথা জানাল কিশোর।
ঠিকই অনুমান করেছ তুমি। দুই রকম পেঁচার ডাক ডাকে সে। একভাবে ডেকে হাইজ্যাকারদের বোঝায়, রাস্তা পরিষ্কার, চলে এসো। আরেক ভাবে ডেকে বলে, বিপদ, চলে যাও। এই দ্বিতীয় ডাকটা শুরু করেছে। তোমরা আসার পর।
তারমানে আমাদের ভয় পায় সে? মুসার প্রশ্ন।
হ্যাঁ, পাই, দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা পরিচিত, ভারী কণ্ঠ।
ঝট করে ঘুরে তাকাল দুই গোয়েন্দা। হাতে লম্বা নলওয়ালা সেই পিস্তলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডোবার। নিঃশব্দে দরজা খুলে কখন ঢুকে পড়েছে টেরই পায়নি কেউ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দু-জন লোক, একজনকে চেনে গোয়েন্দারা–উকিল আর্নি হুগার। আরেকজনের বিশাল দেহ, রুক্ষ চেহারা।
স্বাগতম, রসিকতার ঢঙে বলল ডোবার, সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেলেছ কেসটার। এমনকি পেঁচার ডাকের রহস্য ভেদ করে ফেলেছ, ভাল গোয়েন্দা তোমরা, বুদ্ধি আছে। ডাকগুলো আমিই ডেকেছি, একেবারে আসলের মত হয়েছিল, তাই না? কিন্তু বুদ্ধিটা খারাপ জায়গায় খাঁটিয়েছ, এর জন্যে খেসারত দিতে হবে তোমাদের। কিংবা পুরস্কারও বলতে পারো, জ্যান্ত ডাইনীর সাক্ষাৎ পাবে। তো, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন।
হুঁ, এরা বলবে না। হঠাৎ বদলে গেল তার কণ্ঠস্বর, হাসি হাসি ভাবটা চলে গিয়ে কঠিন হয়ে উঠল চেহারা। কর্কশ কণ্ঠে বিশালদেহী লোকটাকে বলল, ফেরেল, নিশ্চয় বাইরে কোথাও আছে। ধরে নিয়ে এসো। ও পালালে মুশকিল হয়ে যাবে আমাদের।
মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ফেরেল।
হুগারফ রইল রিচটনের পাহারায়, আর পিস্তলের মুখে দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল ডোবার।, একটা গলিপথ পেরিয়ে আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল, যেটাতে হাজতের দরজার মত শিক লাগানো আছে বলেছিলেন রিটন।
ডোবারের টর্চের আলোয় পাথরের ঘরটা দেখতে পাচ্ছে দুই গোয়েন্দা। পেছনের দেয়ালের কাছটায় তেরপল দিয়ে ঢাকা রয়েছে কিছু। বাতাস ভারী আর ভেজা ভেজা এখানে মাটির নিচের ঘর বলেই বোধহয়; কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ!
কোয়ার্টার পছন্দ হয়েছে? হেসে ছেলেদের জিজ্ঞেস করল ডোবার। প্রাকৃতিক গুহাই ছিল এগুলো, খুড়ে খুঁড়ে বড় করেছে ক্রীতদাসপ্রথার। বিরোধিতা করেছিল যারা, তারা। এখানে এসে লুকিয়েছিল। খুব চালাক ছিল ওরা স্বীকার করতেই হবে। কুত্তা চুরি আর রাতে বিকৃত চিৎকার করে করে : ডাইনীর কিংবদন্তীটাকে জাগিয়ে তুলেছিল ওরা, লোকে ভয় পেয়ে আর হোলোর কাছে ঘেঁষত না। ক্রীতদাসদের লুকিয়ে থাকার সুবিধে হত। ইতিহাসের সেই অধ্যায়টাকেই আবার কাজে লাগিয়েছি আমি এত বছর পর, প্রশংসা করবে না?
করতাম, যদি ওদের মত সৎ উদ্দেশ্য থাকত আপনার, কিশোর বলল। কিন্তু আপনি তো করছেন অপরাধ, হাইজ্যাকিঙের মত জঘন্য অপরাধ। ভাল কথা, ভব কোথায় আছে জেনে গেছি আমরা।
মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় দেখা দিল ডোবারের চোখে, তারপর সামলে নিল, কি বলছ বুঝতে পারছি না।
বন্য মানুষের মুখোশ পরে আমাদের ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন না?
না, তা পারছি, হাসিমুখে স্বীকার করল ডোবার। আমিই পিচার সেজেছিলাম, রবারের মুখোশ আর কালো পরচুলা পরে। এ মহাপুরুষের কাজ করেছেন, ডোবারের এই হাসি হাসি ভাবটা সহ্য করতে না পেরে রেগে উঠল মুসা। আমাদের নিয়ে এখন কি করবেন, সেটা শুনতে চাই।
ডোবার বুঝতে পারল অসাধারণ স্নায়ুর জোর এই ছেলেগুলোর, এত সহজে ভয় ধরাতে পারবে না ওদের মনে। কঠিন পথটাই বেছে নিল সে। এগিয়ে গেল তেরপলে ঢাকা জায়গাটার দিকে।
ডাইনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হোক এবার! নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলে একটানে তেরপল সরিয়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল একটা লোহার খাঁচা। ভেতরে শক্তিশালী একটা জানোয়ার। ম্লান আলোতে ঝিক করে উঠল ওটার সবুজ চোখ।
ডাইনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলোর জন্যে এটাকে দায়ী করতে পারো, ডোবার বলল। যখন শুনলাম আমার ভাই নুবার একটা পুমাকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে না পেরে বিক্রি করে দিতে চায়, টরিকে পাঠালাম–ওটা কিনে নিয়ে আসতে। তবে আমি যে কিনছি জানতে দিলাম না নুবারকে। ভাবলাম, জানোয়ারটা পেলে অনেক কাজে লাগাতে পারব। আমার আন্দাজ ভুল হয়নি।
আধমরা ভেড়া কেন কিনেছিল ডোবার, এখন নিশ্চিত হলো গোয়েন্দারা। পুমাকে খাওয়ানোর জন্যেই।
মুসা বলল, আপনার ভাইই যে জানোয়ারকে কন্ট্রোল করতে পারেনি, সেটাকে আপনি করছেন কি করে?
মিটিমিটি হাসছে ডোবার। জন্তু-জানোয়ারকে কন্ট্রোল করার একটাই উপায়, পিটুনি দেয়া, নিষ্ঠুর ভাবে পেটাতে হবে। পুমাটা এখন বুঝে গেছে কে তার মনিব। আমার সঙ্গে তো কই গোলমাল করে না, ভয় পায়।
আজ রাতে ওটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। খাঁচার পেছনে ওই দরজাটা দেখছ না, ওটা খুলে দিই, বেরিয়ে যায়। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ আছে, ও পথে বেরোয়। তবে বেরোতে দেয়ার আগে ঘুমের বড়ি মেশানো খাবার খাইয়ে দিই, যাতে বেশি গোলমাল না করে। পালানোর বুদ্ধি না হয়। প্রতিবারেই ফিরে এসেছে ওটা।