ঠিক, রবিন একমত হলো। সেটা কোনভাবে জেনে গিয়েছিলেন হয়তো ক্যাপ্টেন রিচটন, ওদেরকে মাল খালাস করতে দেখে ফেলেছিলেন, সে জন্যেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
মেরে ফেলেনি তো? শঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা।
কতটা বেপরোয়া ওরা, সেটা এখনও জানি না, জবাব দিল কিশোর। তবে খুনের ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে আটকে রাখাটাই নিরাপদ মনে করবে। কিন্তু কোথায় আটকাল? আরেকটা কথা মনে আছে, সেদিন ডোবারের সঙ্গে কথা বলার সময় দরজা লাগানোর শব্দ শুনেছিলাম, কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে কোন দরজা দেখিনি?
আছে, জানাল দু-জনেই।
কোথায় সেই দরজাটা?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
আমার বিশ্বাস, কিশোরই বলল, রান্নাঘরের মধ্যেই কোথাও আছে ওটা, লুকানো, গুপ্তদরজা।
আর কোন কথা হলো না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল তিনজনে। করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল, কিন্তু ওরা আর আসে না।
দেখা দরকার কোথায় গেল, কিশোর বলল। তোমরা এসো আমার পেছনে। দূরে দূরে থাকবে। ধরা পড়লে যাতে একজন পড়ি, অন্য দুজন, পালাতে পারি।
ঝোপের আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে এগোল সে। তার পেছনে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে রবিন, সবশেষে রইল মুসা।
লোকগুলোকে দেখা গেল না কোথাও। খাদের কিনারে গাছের সারির কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। একটু পর মুসা আর রবিনও চলে এল তার পাশে। খোলা জায়গায় না থেকে বসে পড়ল ঝোপের আড়ালে। নিচে উঁকি দিল।
তাদের সামনে কোন গাছপালা নেই, পাথরের দেয়ালটা প্রায় খাড়া হয়ে নেমে গেছে উপত্যকায়।
শাঁই শাঁই করে বইছে ঝোড়ো বাতাস। তাদের পেছনে সাংঘাতিক দুলছে গাছপালাগুলো। এই ঝোপের কাছেও বাতাসের শক্তি অনুভব করতে পারছে ছেলেরা। বিদ্যুতের আলোয় ব্ল্যাক হোলোর অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ডোবারের কেবিনটাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু লোকগুলোকে চোখে পড়ল। অবাক কাণ্ড! গেল কোথায় ওরা?
ওপরেও নেই, নিচেও নেই, বিড়বিড় করল রবিন, তাহলে গেল কোথায়? আর নিচেই যদি গিয়ে থাকে, নামল কোনখান দিয়ে? যা দেয়ালের দেয়াল, নিচে নামাই মুশকিল, সঙ্গে আছে আবার ভারী বাক্স!
ওরা যেখানে রয়েছে তার ঠিক নিচে নয় কেবিনটা, ওটার ওপরে যেতে হলে একপাশে আরও খানিকটা সরতে হবে। ওখানটায় গেলে লোকগুলোকে দেখা যেতে পারে ভেবে উঠে দাঁড়াল কিশোর। পেছনে আগের মত দূরত্ব রেখে আসতে বলল রবিন আর মুসাকে।
খাদের কিনার ধরে এগোল তিনজনে, একজনের পেছনে আরেকজন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কিশোর। বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়। অবাক হয়ে রবিন আর মুসা দেখল, খানিক আগেও যেখানে ছিল গোয়েন্দাপ্রধান, সেখানে নেই সে, অদৃশ্য হয়ে গেছে!
.
১৫.
কিশোর কিশোর! বলে চিৎকার দিয়ে দৌড় মারল রবিন। মুসা ছুটল তার পেছনে। কিশোর, কোথায় তুমি?
সাড়া নেই। বিদ্যুৎ চমকাল বড় করে, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সবকিছু আলোকিত করে রেখে দপ করে নিভে গেল। আশপাশটা পরিষ্কার চোখে পড়ল ওদের। এবারও দেখা গেল না কিশোরকে। ওই লোকগুলোর মতই সে-ও গায়েব হয়ে গেছে।
গেল কোথায় ও! ককিয়ে উঠল রবিন। তার কথা ঢেকে দিল প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ।
আবার চমকাল বিদ্যুৎ। আকাশটাকে যেন ফেড়ে ফেলে তার ভেতরটা দেখিয়ে দিতে চাইল। মনে হলো, এতক্ষণ মেঘগুলোকে ধরে রেখেছিল যে চাদরটা, সেটাকেও চিরে দিল বিদ্যুৎ। অঝোরে নেমে এল বৃষ্টি। গাছপালার মাথায়, পাথরের গায়ে আঘাত হানার শব্দ উঠল ঝমঝম, ঝমঝম।
কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আরেকটা শব্দ ঢুকল মুসার তীক্ষ্ণ শ্রবণযন্ত্রে, মনে হলো তার পায়ের নিচ থেকে এসেছে।
চিৎকার না? ওদিকে! চেঁচিয়ে উঠে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে একটা বড় ঝোপের দিকে দৌড় দিল সে। আরেকটু হলে সে-ও পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় দেখল সামনে মাটিতে গোল একটা কিছু, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সে।
টর্চের আলো ফেলল দুজনে। মাটিতে একটা গর্ত। ঝোপটার আড়ালে থাকায় দূর থেকে চোখে পড়ে না। উঁকি দিয়ে দেখল, একধার থেকে একটা কাঠের স্লাইড নেমে গেছে। আরেকধার থেকে উঠেছে একটা কাঠের সিঁড়ি।
নিচ থেকে ওদের নাম ধরে ডাকছে কিশোর।
তাড়াতাড়ি নামার জন্যে সাবধানে সাইডের ওপর বসে দুহাতে দু-ধার খামচে ধরল মুসা। পার্কের স্লিপারে বসলে যেমন হয়, তেমনি সড়াৎ করে নেমে চলে এল নিচে। তার পেছনে বসেছিল রবিন, সে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর।
মাটিতে পড়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দু-জনে।
অন্ধকারে কিশোরের গলা শোনা গেল, টর্চ জ্বালো! আমারটা হারিয়ে ফেলেছি!
হলুদ আলো পড়ল পাথরের দেয়ালে। একটা কুয়ার মধ্যে রয়েছে ওরা। সুড়ঙ্গমূর্খ দেখা গেল।
নিশ্চয় এটা চোরের আড্ডা, নিচু স্বরে বলল রবিন। ওই কাঠের সাইডে মালগুলো রাখে, পিছলে নেমে আসে ওগুলো কুয়ার নিচে। পরে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেটাই দেখতে হবে, কিশোর বলল।
সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা। সাবধানে এগোল। কিছুদূর এগোতে সামনে দেখা গেল একটা কাঠের দরজা।
খুলব? রবিনের প্রশ্ন।
না খুললে দেখব কি করে?
এগিয়ে গিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। ভেতরের দিকে খুলে গেল পাল্লাটা।
ওপাশে তাকিয়েই থ হয়ে গেল ওরা। পাথর কুঁদে তৈরি চারকোনা একটা ঘর, একটা প্যারাফিনের ল্যাম্প জ্বলছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা একজন মানুষ। পড়ে আছে একটা ক্যাম্পখাটে। এলোমেলো ধূসর চুল। শব্দ শুনে দুর্বল ভঙ্গিতে মুখটা ঘুরল এদিকে।