কেবিনের পাশের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দূরে হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই দেখো, ওটা কি?
আলো! হোলোর অন্যপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু কিসের আলো?
ডোবারের কেবিনটার ওপর থেকে আসছে না?
সে-রকমই লাগছে, কিশোর বলল। কিছু একটা ঘটছে ওখানে।
চলো, আগে পটিকে বাড়ি দিয়ে আসি। তারপর দেখতে যাব। সব কিছুর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব আজ 1 রহস্যের মধ্যে এ ভাবে লটকে থাকতে ভাল লাগছে না আর।
পথ বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে গাড়িতে উঠল ওরা। মিসেস ভারগনের বাড়ির সামনে এসে থামল। সব ঘরে আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে পাগলের মত ছুটে বেরোলেন মহিলা। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমাকে সাহায্য করো! পৃটিকে খুঁজে পাচ্ছি না! নিশ্চয় বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে! সেই ভয়ঙ্কর ডাক শুনলাম…
জানালা দিয়ে মুখ বের করে ডাকল পটি, মা, এই যে আমি!
হাঁ হয়ে গেল বিস্মিত মা।
দরজা খুলে দিতেই পটি নেমে গেল। ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিল মা। বুকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগল।
কুত্তা খুঁজতে বনে চলে গিয়েছিল সে, মুসা জানাল মিসেস ভারগনকে। ওকে তো পেয়েছিই, ওর কুত্তাটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। দু-একদিনে মধ্যেই এনে দেব।
ব্ল্যাক হোলোতে পেয়েছ ওকে? এই অন্ধকারে ঝড়ের মধ্যে ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাওয়ার মত দুঃসাহস করেছে তার ছেলে, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মহিলা।
হ্যাঁ, ওখানেই পেয়েছি।
কুত্তাটাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আর থাকতে না পেরে আজ… ডাইনীর কথা ভেবেই বোধহয় থমকে গেল মহিলা। শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়নি তো তোর, পটি?
অভয় দিয়ে বলল কিশোর। না, কোন ক্ষতি হয়নি। নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিন। সকালে সব কথা ও-ই বলবে আপনাকে। ডাইনীটা আসলে কি, তা-ও জানাবে।
আবার এসে গাড়িতে চড়ল তিন গোয়েন্দা। এতটাই অবাক হয়েছে মিসেস ভারগন, ওদেরকে ধন্যবাদ জানানোর কথাও ভুলে গেল। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গাড়িটার দিকে।
মূসাকে নির্দেশ দিল কিশোর, ডোবারের কেবিনটা যে পাশে আছে, ঘুরে ওখানটায় চলে যাও।
রাস্তা নেই, উঁচুনিচু জমির ওপর দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোল গাড়ি। খাদের একেবারে কিনার ঘেষে চলছে। ছোট ছোট ঝোপ মাড়িয়ে যাচ্ছে। নিচু ডাল বাড়ি লাগছে উইন্ডশীল্ডে। গতি, একেবারে কমিয়ে রেখেছে মুসা। শক্ত হাতে ধরেছে স্টিয়ারিং। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলেই, স্টিয়ারিং ভুল। ঘোরালেই পড়বে গিয়ে খাদে।
হেডলাইটের আলো পড়ল আরেকটা গাড়ির ওপর। খাদের, একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, পুরানো একটা জেলপি। রবিন বলল, খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়। ফেলে রেখে গেছে।
এগিয়েই চলল মুসা, রহস্যময় আলোটার সন্ধানে, খানিক আগে কেবিনের কাছে দাঁড়িয়ে যেটা দেখা গেছে।
আরও কিছুদূর এগোতেই মোটামুটি চওড়া খোলা একটুকরো জায়গায় ঢুকল গাড়ি। আরেকটু এগোলেই ডোবারের কেবিনের ওপর চলে যাবে, যেখানটায় আলো দেখেছে। থেমে গেল মুসা। কি করবে জিজ্ঞেস করল কিশোরকে।
আর এগিও না। এখানেই গাড়ি ঘুরিয়ে রেডি রাখো, কিশোর বলল। দরকার পড়লে যাতে এসেই দৌড় দিতে পারি। তখন হয়তো আর ঘোরানোর সময় থাকবে না।
বাতাসের বেগ বেড়েছে। যে কোন মুহূর্তে বনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝড়। অনেক ডালপালা ছড়িয়ে আকাশের এমাথা ওমাথা চিরে দিয়ে গেল। বিদ্যুৎ-শিখা, সঙ্গে সঙ্গে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল। তারপর এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, টর্চ জ্বালার আর প্রয়োজন হলো না।
সরু পথে চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল ওরা। কথা শোনা গেল, এই যে, ধরো তো এটা।
চট করে ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল গোয়েন্দারা। যেদিকে কথা শোনা গেছে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখল, একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে লম্বা একটা বাক্স নামাচ্ছে দু-জন লোক। নামিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল গাছপালার মধ্যে, হোলোর কিনারের দিকে।
কোথায় গেল? ফিসফিস করে বলল রবিন, ওদিকে তো জায়গা নেই। না জেনে এগোলে পড়ে যাবে নিচে।
উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল গোয়েন্দারা, কিন্তু লোকগুলো ফিরল না।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে কিশোর। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব যেন মিলতে আরম্ভ করেছে। সমাধান হয়ে আসছে ধাঁধার। বলল, শোনো, পিচার দুটো পেচা একে কেন কেটে দিয়েছিল, বুঝে গেছি। ও বোঝাতে চেয়েছে, চিৎকারগুলো পাখিতে করেনি, করেছে মানুষে। এক ঢিলে দুই পাখি মারে কেউ। যারা ট্রাক নিয়ে আসে পেঁচার ডাক ডেকে তাদেরকে সঙ্কেতও দেয়, আবার আশপাশের মানুষকে হুঁশিয়ারও করে: খবরদার, এদিকে এসো না; এখানে ডাইনী আছে! সেটাকে আরও জোরদার করার জন্যে কুকুর চুরি করে। ভয় পেয়ে কেউ এদিকে না এলে নিরাপদে মাল খালাস করতে পারে ওরা।
কুকুরগুলোকে এনে কি করে তা-ও বুঝে ফেলেছি! রবিন বলল, নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় চোরাই মার্কেটে। পটিরটা বোধহয় তাড়াহুড়োয় বেচতে পারেনি, দিয়ে এসেছে ডরোথির কাছে।
তারমানে বেআইনী কিছু করছে ওরা এখানে? মুসার প্রশ্ন।
তাতে কোন সন্দেহ আছে কি? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
কি করছে?
আমার তো মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে এই এলাকায় যে শুরু হয়েছে, সেটা এদেরই কাজ। ডোবারও এতে জড়িত।