হঠাৎই চোখে পড়ল ওটাকে। কালো, ভারী একটা শরীর, বিশাল বেড়ালের মত চারপায়ে ভর করে বেড়ালের মতই হেলেদুলে বন থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গাটায়। তারপর নিঃশব্দে, যেন বাতাসে ভেসে পার। হয়ে গিয়ে ঢুকল অন্য পাশের কালো বনের মধ্যে।
বনবেড়াল! ফিসফিসিয়ে বলল উত্তেজিত রবিন। এই তাহলে ডাইনী! চিৎকার ওটারই!
কিন্তু এখানে বনবেড়াল আসবে কোত্থেকে? প্রতিবাদ করল কিশোর, এই অঞ্চলে ওই জীব বাস করে না। তাছাড়া বনবেড়াল এত বড় হয় না।
চুপ! ওদের থামতে বলল মুসা, এখনও আগের ক্ষীণ শব্দটা শোনার চেষ্টা করছে।
এইবার শুনতে পেল তিনজনেই। বাতাসের গর্জন আর বজ্রের শুড়গুডুকে ছাপিয়ে শোনা গেল পাতলা, কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার, বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ, ডব! ডঅব! ডবিইইই!
খাইছে! এ তো পটি! বলে উঠল মুসা, এত রাতে বনের মধ্যে এসেছে। কুকুর খুঁজতে!
সামনেই আছে কোথাও! কিশোর বলল।
তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই ভীষণ চিৎকারটা আবার শোনা গেল। থেমে যেতেই কানে এল বাচ্চা ছেলের ভীত ফোপানোর শব্দ, ডব, ডবি, কোথায় তুই?…আমার ভয় লাগছে।
আর শোনার অপেক্ষা করল না তিন গোয়েন্দা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল শব্দ লক্ষ্য করে। আবার চিৎকার করে উঠল বিশাল জন্তুটা।
পটারের কান্নার শব্দ জোরাল হচ্ছে, আমার ভয় লাগছে। আমি বাড়ি যাব! মা, মাগো, কোথায় তুমি!
চিৎকার করে মুসা বলল, পটি, যেখানে আছো দাঁড়িয়ে থাকো! নোড়ো না!
সামনে হঠাৎ পথ আটকে দিল একটা গাছের মাথা, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ডালপাতা। নিচের উপত্যকায় গোড়া ওটার, মাথাটা উঠে এসেছে এখানে। তারমানে গর্তের কিনারে পৌঁছে গেছে গোয়েন্দারা, সামনে খাড়া হয়ে নেমেছে দেয়াল।
কিনারে এসে টর্চ জ্বেলে মরিয়া হয়ে পথ খুঁজল ওরা। প্রথমে চোখে পড়ল শুধু ঝড়ে দুলন্ত গাছপালার মাথা।
ওই যে? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
অবশেষে সবকটা টর্চের আলোই খুঁজে পেল ছোট্ট ছেলেটাকে। জারসি আর শর্ট ট্রাউজার পরনে, ওদের নিচে বড় একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে। থরথর করে কাঁপছে। একহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে, আরেকটা হাত তুলে রেখেছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।
কয়েক গজ দূরে টর্চের আলোয় ঝিক করে উঠল ভয়ঙ্কর দুটো সবুজ চোখ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে শিকারের দিকে। কেশে ওঠার মত শব্দ করল জানোয়ারটা। ধীরে ধীরে শরীরের সামনের অংশ নিচু হয়ে যাচ্ছে। লেজ নাড়ছে এপাশ ওপাশ। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ওটা।
বিশাল এক পুমা। হলুদ রঙ।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা। গর্তের কিনারের একটা বড় পাথর দেখিয়ে বলল, কিশোর, ওই পাথরটা গড়িয়ে দাও আমি পটিকে তুলে আনছি!
জানোয়ারটার চোখে টর্চের আলো নাড়ছে রবিন, ওটাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্যে। তাতে আক্রমণ চালাতে দেরি করবে, সময় পাবে মুসা। কিশোর ছুটে গেল পাথরটার দিকে।
কোন রকম দ্বিধা না করে শূন্যে ঝাঁপ দিল মুসা। পড়ল বড় গাছটার মাথায়। একটা ডাল ধরে ফেলল। তারপর এ ডাল থেকে সে-ডালে দোল খেতে খেতে নেমে চলে এল পটির মাথার ওপরের একটা নিচু ডালে।
টর্চের আলো দেখে ওপরে তাকিয়ে আছে পটি।
দড়াবাজিকরের মত হাঁটু ভাজ করে ভেতরের দিকটা ডালে আটকে দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল মুসা। দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জলদি হাত ধরো!
ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে পটি। মূসার কথা যেন বুঝতেই পারল না। তাকিয়ে আছে নীরবে। তারপর যেন যন্ত্রচালিতে মত ধীরে ধীরে ওপর দিকে তুলে দিতে লাগল দুই হাত।
গর্জন করে সামনে ঝাঁপ দিল পুমাটা। একই সময়ে ডাল আর ঝোপঝাড় ভেঙে ওটার ওপর নেমে আসতে লাগল পাথর। মাটি ভিজে গোড়া আলগা হয়ে ছিল, কাজেই ঠেলে ফেলতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি কিশোরের।
থমকে গেল জানোয়ারটা। এই সুযোগে পটির হাত দুটো চেপে ধরে ওপর দিকে তুলে ফেলল মুসা। তাকে নিয়ে উঠে বসল ডালের ওপর।
লাফিয়ে উঠে দুজনকেই ধরে ফেলতে পারত জানোয়ারটা। কিন্তু ওপর থেকে খসে পড়া বিরাট পাথর ঘাবড়ে দিল তাকে, একলাফে ঢুকে পড়ল ঝোপের মধ্যে। আর বেরোল না।
পটিকে নিয়ে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে আসতে যথেষ্ট কসরত করতে হলো মুসাকে। গাছের মাথার কাছে পৌঁছে একটা ডাল বেয়ে চলে এল খাদের কিনারে। হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে টেনে নিল কিশোর আর রবিন।
মুসাও নেমে উঠে এল খাদের কিনারে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে।
উত্তেজনা শেষ হয়ে যেতে হঠাৎ করেই যেন ক্লান্তিতে হাঁটু ভেঙে আসতে লাগল তিনজনের। খাদের কিনার থেকে সরে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
রবিন বলল, একটা খেলা দেখালে বটে তুমি, মুসা! টারজান ছবিতে হীরোর রোলটা চাইলেই তোমাকে দিয়ে দেবে পরিচালক।
মুসা বলল, কাজে লেগেছে কিশোরের পাথর ফেলাটা। ওটা না পড়লে ভয়ও পেত না, যেও না জানোয়ারটা। পটি আর আমি দুজনেই মরতাম!
ফোঁপাচ্ছে এখনও পটি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল রবিন, কেঁদো না, আর ভয় নেই। বাড়ি নিয়ে যাব তোমাকে। কুকুরটাকে খুঁজতে এসেছিলে তো? ওটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। শীঘ্রি এনে দেব।
সত্যি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
এ ভয়ে, ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে ছেলেটা, হাঁটারও শক্তি নেই। তাকে কোলে তুলে নিল মুসা। টর্চ জেলে আগে আগে চলল কিশোর, পেছনে রইল রবিন। সতর্ক রইল, অন্য কোন দিক দিয়ে ঘুরে এসে যাতে আক্রমণ চালাতে না পারে জানোয়ারটা। ঢাল থেকে নেমে, উপত্যকা পার হয়ে কেবিনে ওঠার পথটায় পড়ল ওরা। নিরাপদেই উঠে এল ওপরে। বিদ্যুতের বিরাম নেই, থেকে থেকেই চমকাচ্ছে। বনের বাইরে বেরিয়ে এসে এখন আকাশ চোখে পড়ছে। দেখা গেল, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, একখানে জড় হতে পারছে না, তীব্র বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতিউতি।