চোখের পলকে দুটো টর্চের আলো বিদ্ধ করল মূর্তিটাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন, ও, তুমি, পিচার!
কি চাও? জিজ্ঞেস করল মুসা, তারপর মনে পড়ল পিচার বোবা, জবাব দিতে পারবে না।
বসে পড়ল পিচার। কিশোর, রবিন, আর মুসার দিকে আঙুল তুলে হাত নাড়ল জোরে জোরে।
মনে হয়, তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের পালাতে বলছে, রবিন বলল। নিশ্চয় কোন বিপদ! কি বিপদ, পিচার? পকেট থেকে নোট্টবুকের পাতা ছিঁড়ে দিল সে। পেন্সিল বের করে দিল কিশোর।
টর্চের আলোয় দ্রুত একটা জানালাবিহীন কেবিন এঁকে ফেলল ছেলেটা। একমাত্র দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা বন্দুকের নল।
ডোবারের কেবিন, উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল রবিন। তার কাছে। বন্দুক আছে। কি করছে…
দাঁড়াও, বাধা দিল কিশোর আরও কিছু আঁকছে।
দুটো পেঁচার মাথা আঁকল পিচার। কিন্তু একটা পেঁচার খাড়া খাড়া কান, আরেকটার কান নেই বললেই চলে। পেঁচার চেয়ে বানরের মুখের সঙ্গেই ওটার মিল বেশি।
আঁকিয়ে বটে! আবারও প্রশংসা করতে হলো রবিনকে, দারুণ হাত! দেখলে, বলেছিলাম না পেঁচার ডাক? দুটো দুরকম পেঁচা। একটার ডাকের সঙ্গে মানুষের গলার মিল বেশি, সেটাকেই ডাইনী ভাবে লোকে।
এঁকেই ক্রস চিহ্ন দিয়ে দুটোকে কেটে দিল পিচার। হাত নেড়ে আবার চলে যেতে বলল তিন গোয়েন্দাকে।
বুঝলাম না, কিশোর বলল। পেঁচাকে ভয় পাও তুমি?
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পিচার।
ডাইনীর সঙ্গে পেঁচার সম্পর্ক আছে বলছ? ওগুলোর কবল থেকে বাঁচাতে চাও আমাদের?
জোরে মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা।
মনে হয়, মুসা বলল, পেঁচাগুলোকে গুলি করার কথা বলছে ডোবার।
মাথা নাড়ল পিচার, মুসার অনুমানও ঠিক না।
নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। তবে ডাইনীই হোক, পেঁচাই হোক, কিংবা ডোবার, কারও ভয়েই এখান থেকে যাচ্ছি না আমরা। বুঝলে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল পিচার। তারপর নিরাশার ভঙ্গি করল।
কিশোর বলল, বরং একটা উপকার করতে পারো আমাদের। কুকুরের বাচ্চাটা একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। ওকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, তাতে আমাদের কাজ করতে সুবিধে হবে। একলা ওকে ঘরের মধ্যে ফেলে রাখাটা নিষ্ঠুরতা।
মাথা ঝাঁকাল পিচার। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি করেই হারিয়ে। গেল গাছের আড়ালে।
আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকারে বিড়বিড় করল কিশোর, সারাক্ষণই ডোবারের পেছনে লেগে আছে! নিশ্চয় তার সঙ্গে কোন দুর্ব্যবহার করেছে লোকটা… পেঁচা এঁকে কি বোঝাতে চাইল, বুঝতে পারলে ভাল হত…
বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়।
সর্বনাশ, বৃষ্টি আসবে নাকি? শঙ্কিত হয়ে উঠল রবিন, তাহলে তো আর বাইরে থাকা যাবে না।
মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবেই, কিশোর বলল। ঝড় এখনও অনেক দূরে, আসতে দেরি আছে। দেখি, যতক্ষণ থাকতে পারি থাকব।
কয়েক মিনিট পর খুট করে একটা শব্দ হলো।
কি ব্যাপার? আবার ফিরে আসছে নাকি পিচার? মুসার প্রশ্ন।
ছেলেটা যেদিকে গেছে সেদিকে তাকাল কিশোর। আরও গাঢ় হয়েছে। অন্ধকার। মেঘ জমেছে আকাশে, তারার আলোও নেই।
আবার হলো শব্দটা।
তারপরই ভারি নীরবতাকে খান খান করে দিল ভয়াবহ, তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণে আবার। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরও একবার। কেমন যেন মানুষের চিৎকারের মত।
প্রথম রাতে এই চিৎকারই শুনেছি! নিশ্চয় কেউ বিপদে পড়েছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জলদি ওঠো!
ডাইনীটা তো আছেই দেখা যাচ্ছে, গল্প নয়! জুতো পায়ে গলাতে গলাতে বলল মুসা। কাউকে ধরে এনে রক্ত খাওয়ার তাল করছে নাকি?
জবাব দিল না কেউ। এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকাল।
কিশোরের জুতো পরা শেষ। বলল, কাছেই কোথাও। চলো।
টর্চ জ্বেলে দৌড় দিল ওরা। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর, কারণ আবার শোনা গেল চিৎকার। কোনখান থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করল। উপত্যকার নিচে নয়, ওপরে, ঢালের গায়ে রয়েছে, বলল সে। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পায়েচলা পথটা ধরে ছুটল আবার।
ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল আবার।
হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, আর তো শোনা যাচ্ছে না! যাব। কোনদিকে?
আমি কিন্তু আরেকটা শব্দ শুনছি, কান পেতে আছে মুসা,। তোমার শুনছ না?
শোনাটা কঠিনই। কারণ এখন আর নীরব হয়ে নেই রাতটা। ঝড় আসার সঙ্কেত জানিয়ে শুরু হয়ে গেছে প্রবল বাতাস, দমকে দমকে ঢেউয়ের মত আসছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোয় চোখে পড়ছে দুলন্ত গাছের মাথা, পাগল হয়ে উঠেছে যেন গাছগুলো। এদিকে মাথা নোয়াচ্ছে, ওদিকে হেলে পড়তে চাইছে, মড়মড় করে উঠছে ডাল, পাতার মধ্যে দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে দিয়েও শব্দটা ঠিকই কানে আসছে মুসার। স্বর
কিসের শব্দ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মানুষের চিৎকার বলে মনে হলো কিন্তু বাতাস যা আরম্ভ করেছে, বুঝতে পারছি না…
বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল, থাকল অনেকক্ষণ। হাত তুলে কাছের একটা গাছ দেখাল রবিন। চুপ করে বসে আছে একটা পেচা, বাতাসের পরোয়া করছে না, বড় বড় চোখগুলো কেমন ভূতুড়ে লাগল। ক্ষণিকের জন্যে দেখা, গেল দৃশ্যটা, আলো নিভে যেতেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
আচমকা উপত্যকার নিচ থেকে ভেসে এল ভয়াবহ চিৎকার। ভীষণ চমকে দিল তিন গোয়েন্দাকে। মনে হলো এগিয়ে আসছে শব্দটা। তাড়াতাড়ি কাছের একটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। নজর বাঁয়ের–একটুখানি ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গার দিকে।