দেখি, জবাব দিল কিশোর, একটা কিছু বের করেই ফেলব।
পুরানো আমলের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি রাখল রবিন। এখানেই থাকে ডরোথি। একসঙ্গে সবাই ঢুকলে বিরক্ত হতে পারে মহিলা, সেজন্যে কিশোর একাই চলল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে কাঁচের দরজায় লাল রঙে লেখা দেখতে পেল:
ড্রেস ডিজাইনার
ডরোথি আরিগন
খোলা দরজা। ভাল রকম সাজানো গোছানো একটা সিটিং রুমে ঢুকল। কিশোর। কেউ নেই। হয়তো ভেতরে গেছে, আসবে ভেবে একটা সোফায় বসে পড়ল সে। চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। পুরু কার্পেট, চকচকে পালিশ করা আসবাবপত্র, চমৎকার ডেকোরেশন। ব্যবসা ভালই চলছে।
প্রায় নিঃশব্দে খুলে গেল একটা দরজা। ঘরে ঢুকল লম্বা, সুন্দরী এক মহিলা, বয়েস চল্লিশের কোঠায়, কালো চুল। গর্বিত ভঙ্গিই প্রমাণ করে দেয়, আরিগনদের বংশধর। তার পেছনে ছাগলছানার মত লাফাতে লাফাতে বেরোল হাসিখুশি একটা ছোট কুকুর। এগিয়ে এল কিশোরের দিকে।
ওটার মাথা চাপড়ে দিতে গিয়ে হাত থেমে গেল তার। মনে পড়ল। বাদামী রঙের কুকুর, একটা কান সাদা! গলায় কলার নেই, নাম লেখা ট্যাড নেই। পটির ডব নয় তো এটা?
উঠে দাঁড়াল কিশোর, হেসে বলল, সুন্দর কুকুর। অবিকল একই রকমের আরেকটা কুকুর দেখেছি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। মনে হয় এটার ভাইই হবে। পেলেন কোথায়, মিস আরিগন?
আমার ভাই দিয়েছে, মহিলা গোমড়ামুখো নয়, তবে ততটা আন্তরিকও নয়। বনের মধ্যে নাকি একা একা ঘুরছিল। মালিককে খুঁজে পায়নি। সে কুকুর পছন্দ করে না। তাই আমাকে দিয়ে গেছে।
ব্ল্যাক হোলোতে থাকেন যে, মিস্টার ডোবার আরিগন, তিনি নন তো?
চেনো নাকি?
পরিচয় হয়েছে। ওখানে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বনের মধ্যে দেখা হয়ে গেল, একটা পাথরের কেবিনে সন্ন্যাসী হয়ে আছেন মিস্টার আনি।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে ডরোথি, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, সন্ন্যাসী!
সে-রকমই তো মনে হলো। তিনিও তাই বললেন।
কি জানি? অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডরোথি। হ্যাঁ, বলো কি জন্যে। এসেছ?
ডিজাইন। আপনার অনেক নামটাম শুনে মা বলছিল, আপনার কাছ। থেকে পোশাকের একটা নতুন ডিজাইন নিতে পারলে ভাল হত। এদিকে একটা কাজে এসেছি, আপনার বাড়ির সামনে নেমপ্লেটটা দেখে হঠাৎ মনে পড়ল মার কথা। ঢুকে পড়লাম।
হাসল মহিলা। তুমি খুব ভাল ছেলে, কবে কি বলল ঠিক মনে রেখে দিয়েছ। মায়ের কথা শোনে নাকি আজকালকার ছেলেরা! ঠিক আছে, তোমার মাকে গিয়ে বোলো আমার কাছে চিঠি লিখতে। কি চায় বুঝে দেখি।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে লক্ষ করছে কিশোর। তাকে সন্দেহ করছে না তো? কিন্তু ডরোথির হাসিমুখ দেখে তার মনের কথা কিছুই আঁচ করতে পারল না সে। আর কোন প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে বলল, আচ্ছা, যাই।
চিন্তিত ভঙ্গিতে গাড়িতে এসে উঠল সে। কি জেনেছে জানার জন্যে উৎসুক হয়ে আছে দুই সহকারী গোয়েন্দা। কিশোর বলল, পটির কুকুরটাকে খুঁজে পেয়েছি। চুরি করে এনে বোধহয় বোনকে দিয়ে দিয়েছে ডোবার।
মুসা বলল, বলো কি? দান করার জন্যে চুরি করে, এমন কথা তো শুনিনি।
কি জানি, বুঝতে পারছি না!
আর কি জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আমাদের কাজে লাগার মত কিছু না। মহিলার ব্যবসা খুব গরম, এটা বুঝলাম। টাকার জন্যে সম্পত্তি বিক্রি কিংবা বেআইনী কাজ করার কোনই প্রয়োজন নেই।
তারমানে এগোনো আর গেল না, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। রহস্যের জট থেকেই গেল!
জট ছাড়াতে হলে একটা জায়গারই খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, ব্ল্যাক হোলো। ভাবছি, আজ রাতে কেবিনে না থেকে বনের মধ্যেই ক্যাম্প করে থাকব কিনা। রাত হলে ফিরব আমরা। ঘরেও ঢুকব না, আলোও জ্বালব না। আমরা চলে গেছি মনে করে এমন কিছু করে বসতে পারে ডোবার, যা সব রহস্যের সমাধান করে দেবে।
এতটা সময় তাহলে কি করব?
ঘুরে বেড়াব। এলাকাটা দেখব।
.
১৪.
ক্যাপ্টেনের কেবিনের কাছে গাড়ি নিল না ওরা। পথের পাশে কয়েকটা গাছের আড়ালে পার্ক করে রেখে অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে ঢুকল কেবিনে। কুকুরটাকে বাধল রান্নাঘরে, তাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না, কিছু দেখলে চিৎকার শুরু করবে। একা তাকে এ ভাবে ফেলে যেতে ভাল লাগছে ওদের, তবু কিছু করার নেই। স্লীপিং ব্যাগগুলো বের করে নিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের বনে, পায়েচলা পথ ধরে নেমে এল উপত্যকায়। একটা ঘন ঝোপের ধারে শোয়ার ব্যবস্থা করল।
চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগল কিশোর। কয়েকটা তারা মিটমিট করছে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশ খুব একটা চোখে পড়ে না; পড়লে দেখত, দিগন্তের কাছে ইতিমধ্যেই জমে গেছে একটুকরো কালো মেঘ।
ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার।
অন্ধকারে মুসার ফিসফিসে কণ্ঠ শোনা গেল, শুনছ!
হ্যাঁ, জবাব দিল রবিন, পেঁচা ডাকছে।
কয়েক মিনিট পর আবার ডাক শোনা গেল, এবার অন্য রকম। কয়েকবার ডেকে থেমে গেল।
এটা পেঁচা নয়! গলা কাঁপছে মুসার। ডাইনী!
হ্যাঁ, কিশোর বলল, পেঁচার মত ঠিক না, বরং মানুষের চিৎকারের সঙ্গে মিল আছে। প্রথম রাতে যেটা শুনেছিলাম, তার সঙ্গে এগুলোর একটারও মিল নেই।
সেজন্যেই তো বলছি পেঁচা, জোর দিয়ে বলল রবিন। তবে দু-রকম পেঁচা।
প্রথম দিনেরটা তাহলে কি ছিল..? অন্ধকারে গাছের আড়াল থেকে। লম্বা একটা ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখে চমকে উঠে বসল মুসা, কে!