…বললাম না, ডরোথির সঙ্গে দেখা করেছি আমি! হুগারফ বলছে, একচুল নড়াতে পারিনি ওকে। তার সেই এক কথা।
অধৈর্য ভঙ্গিতে চেয়ার ঠেলে সরানোর শব্দ হলো। শোনা গেল ডোবারের ভারি গলা, অসহ্য! এ একটা জীবন হলো নাকি! এ ভাবে বাঁচা যায়! আর দেরি করতে পারব না, আমি আমার সম্পত্তির ভাগ এখনই চাই!
চাইলেই তো আর হলো না, মীমাংসা করতে হবে আগে..আমিও বিরক্ত হয়ে গেছি। অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছে তোমার কাছে, সেটা যে কবে পাব কে জানে! আসল কথা বলো এখন, এদিকের খবর কি?
জবাব শোনার আশায় কান খাড়া করে রইল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু কথা শোনা গেল না, তার পরিবর্তে চেয়ার টানাটানি..
কথা বলছে না কেন? ভাবল কিশোর। নাকি হুগারফকে কিছু দেখাচ্ছে। ডোবার?
হঠাৎ তার কাঁধ খামচে ধরল মুসা। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কেউ আসছে? একদম নড়বে না!
পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন কিশোর আর রবিনও। দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আশা করল, এ ভাবে থাকলে, যে আসছে তার চোখে পড়বে না ওরা এই অন্ধকারে। কিন্তু যদি টর্চ জ্বালে? আর আসছেটাই বা কে? ভাইয়ের পরিস্থিতির খবর পেয়ে তাকে দেখতে এসেছে নুবার? নাকি পিচার? পিচার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ এখানে ডোবারের পিছে লেগে থাকে সে; নিশ্চয় কারা আসে কারা যায় লক্ষ করে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল পদশব্দ। পনেরো মিনিট চুপ করে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল গোয়েন্দারা। কিন্তু আগন্তুকের আর কোন সাড়া নেই।
.
১৩.
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ ব্যথা করে ফেলল ওরা, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
কেবিনের ভেতর আবার ভারী গলায় কথা বলে উঠল ডোবার, খুব শীঘ্রি কিছু টাকা পেয়ে যাব। না পেলে আমারও চলবে না আর। কিছু একটা করতেই হবে!
হ্যাঁ, ভাল কথা, ছেলেগুলোর কি খবর? আচমকা প্রশ্ন করল হুগারফ।
যায়নি এখনও। আমার মনে হয় রিচটনের ভাবনাটা এখনও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
ওদের কথাই আলোচনা হচ্ছে, বুঝতে পারল কিশোর।
ভাগাতে হবে তো। নইলে কখন কোন বিপদে ফেলে দেবে কে জানে! সাংঘাতিক ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব।
বুঝতে পারছি না কি করব? দেখা যাক!
দরজা খোলার ক্যাচকোচ শব্দ হলো। দেয়ালের সঙ্গে গা চেপে ধরে মিশে রইল তিন গোয়েন্দা, পারলে পাথরের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়।
খোলা দরজা দিয়ে আলো পড়ল ঘাসের ওপর। বেরিয়ে এল উকিল। পেছনে আবার দরজা লাগিয়ে দিল ডোবার। বনে গিয়ে ঢুকল হুগারফ, পায়ের শব্দ ঢাকার কোন চেষ্টাই করল না।
পথের ধারের একটা কালো ঝোপ নড়ে উঠল বলে মনে হলো কিশোরের, মুসারও চোখে পড়ল ব্যাপারটা। তারমানে এতক্ষণ কেউ লুকিয়ে ছিল ওখানে।
এগিয়ে গেল হুগারফের পদশব্দ। যে ঝোপটা নড়েছে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লম্বা ছায়ামূর্তি। পিছু নিল উকিলের।
আমাদের ওপর নয়, ফিসফিস করে মুসা বলল, হুগারফের ওপর নজর রাখছিল। কোথায় যায় দেখব?
দেখো তো, জবাব দিল কিশোর। আমরা এখানেই আছি। দেখি, আর কি ঘটে, আর কেউ আসে কিনা?
কয়েক মিনিট পরই ফিরে এল মুসা। জানাল, পিচারের মতই মনে হলো। ও আসলে চোখে চোখে রাখছে লোকগুলোকে।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
স্বাভাবিক কৌতূহল হতে পারে। নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে।
বসে আছে তো আছেই ওরা। খুব ধীরে কাটছে একঘেয়ে সময়, স্থির হয়ে আছে যেন। কিন্তু আকাশের তারাগুলোর স্থান পরিবর্তন প্রমাণ করে দিল, না, ধীরে হলেও সময় কাটছে। পুবের আকাশে হালকা একটা আভা ফুটল। অবশেষে গাছপালার মাথার ওপর বেরিয়ে এল কাস্তের মত বাকা হলুদ চাঁদ। হালকা, কনকনে ঠাণ্ডা একঝলক বাতাস যেন লাফ দিয়ে এসে নামল বদ্ধ উপত্যকাটায়।
আবহাওয়া পরিষ্কার হলে কি হবে, পার্বত্য এলাকার ঘন শিশির ঠিকই পড়তে লাগল। ভিজিয়ে দিল ছেলেদের চুল, কাপড়। সেঁতসেঁতে কাপড় পরে। থাকাটা এমনিতেই অস্বস্তিকর, তার ওপর এই ঠাণ্ডা বাতাস কাপুনি ধরিয়ে দিল শরীরে। একভাবে বসে থেকে থেকে পায়ের পেশীতে খিল ধরে গেছে।
এতক্ষণ ডোবারের কেবিনের দরজায় যে হালকা আলোটা ছিল, সেটাও নিভে গেল। শুয়ে পড়েছে বোধহয় সে। আর বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠল ওরা। ফিরে চলল নিজেদের কেবিনে।
খাড়া পথ বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরল মুসা, শুনছ!
অবশ্যই শুনছে কিশোর আর রবিনও। কাঁপা কাঁপা একটা টানা তীক্ষ্ণ চিৎকার।
নিশ্চয় সেই পেঁচাটা! রবিন বলল। এল কোনখান থেকে?
হোলোর ওপার থেকে, জবাব দিল কিশোর। মনে তো হলো, ডোবারের ঘরের কাছেই ডাকল।
ভালই হয়েছে, কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলল মুসা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, আমরা ওখানে থাকতে ডাকেনি। তাহলে বারোটা বাজত! ভূতের সঙ্গে
পেঁচার বড় ভাব! একসঙ্গে উড়ে চলে ওরা আকাশপথে!
হোলোর ওপর উঠে এল ওরা। কেবিনের আলোর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অন্য এক জগৎ থেকে যেন বেরিয়ে এল পরিচিত পৃথিবীর অভ্যস্থ পরিবেশে। ভূত বিশ্বাস না করলেও, মুসার মত ভয় না পেলেও পেঁচার ডাকটা অন্য দু-জনেরও ভাল লাগেনি।
কেবিনে ঢুকে দেখল, ভালই আছে ফগ। মুসাকে দেখে আদুরে গলায় কুঁই কুঁই শুরু করল। এগিয়ে গিয়ে ওটাকে আদর করল সে।
ঘুমানোর আগে ঠাণ্ডা দূর করার জন্যে মগে গরম চকলেট ঢেলে নিয়ে বসল তিনজনে।