আমরা ইতিহাসের ছাত্র, অনেক দুরে লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বীচ থেকে বেড়াতে এসেছি। ভাবলাম, এসেছি যখন, এই এলাকার ইতিহাস যতটা সম্ভব জেনে যাই, পরীক্ষার সময় কাজে লাগবে। ডাচ পেনসিলভ্যানিয়া সম্পর্কে এমনিতেও আমাদের কৌতূহল আছে।
ও, কিছু সন্দেহ করল না নুবার।
আপনাদের তো শুনলাম অনেক জায়গা-সম্পত্তি আছে এখনও, ফকির বলছেন কেন? পুরো ব্ল্যাক হোলোটাই আপনাদের।
মাথা ঝাঁকাল নুবার, অনেক বড় সম্পত্তি, তা ঠিক। কিন্তু সেটা নিয়ে মারামারি করলে তো আর ভোগ করা যায় না। বাবা মারা যাওয়ার পর। জায়গাটা নিয়ে কি করব আমরা, এই একটা সামান্য ব্যাপারেই একমত হতে পারিনি এখনও তিন ভাইবোন। কেস চলছে। তর্কের পর তর্ক করে চলেছে। তিন পক্ষের উকিল। কেউ কোন সমাধানে আসতে পারেনি।
সম্পত্তি থেকে একটা কানাকড়িও পাই না। বসে থাকলে তো আর পেট চলে না, তাই এই কাজ নিয়েছি। জন্তু-জানোয়ারে আমার ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ। শখের বশে জানোয়ারকে ট্রেনিং দেয়ার কাজটাও শিখে ফেললাম। সেই শিক্ষাই এখন আমার রুটিরুজির উপায়। এই কাজকে ভাল চোখে দেখে না আমার অন্য দুই ভাইবোন। না দেখুক, আমিও তাদের কাছে যাই না… সরাসরি কিশোরের দিকে তাকাল নুবার। ডোবারের সঙ্গে তাহলে ব্ল্যাক হোলোতেই দেখা হয়েছে তোমাদের? সে যে এই এলাকায় এসেছে আবার, জানতাম না। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ওখানে কি করছে?
তেমন কিছু না। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছে ব্ল্যাক হোলোর পুরানো কেবিনটায়।
সন্ন্যাসী! বিস্ময়ে কাছাকাছি হয়ে গেল নুবারের ঘন ভুরুজোড়া। অসম্ভব! ও টাকা ছাড়া চলতে পারে না! বিলাসিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না!
দেখে তো মনে হলো, বেশ সুখেই আছে, খোঁচা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করল কিশোর।
কি জানি? নাক চুলকাল মুবার। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। পাগলই হয়ে গেল না কি…সত্যি যদি তার এই পরিবর্তন হয়ে থাকে, খুশিই হব।
খাওয়া-দাওয়ায়ও বিলাসিতা তেমন আছে বলে মনে হয় না, মুসা বলল। সেদিন একটা আধমরা ভেড়া কিনে নিয়ে যেতে দেখলাম। ওই বুড়ো ভেড়ার মাংসই বোধহয় খান।
খবরটা হজম করতে সময় লাগল নুবারের। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এতটা পরিবর্তন! নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না! ভেড়ার মাংস দু-চোখে দেখতে পারে না ও। এখন সেই মাংসই খায়, তা-ও আবার বুড়ো ভেড়ার…
পুষতে-টুষতে নেননি তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা খারাপ! জন্তু-জানোয়ার তার শত্রু। একটা কুত্তা পর্যন্ত পালতে পারল না কোনদিন।
কুত্তার কথাই যখন উঠল কি ভাবে নেবেন আপনি জানি না, মিস্টার আরিগন–তবু বলেই ফেলি, কিশোর বলল। যদি বলি আপনার ভাই কুত্তা কিডন্যাপিঙের সঙ্গে জড়িত?
কি ভাবে নিয়েছে নুবার, সেটা তার চেহারা দেখেই অনুমান করা গেল, বজ্রাহত হয়ে পড়েছে যেন। সামলে নিতে সময় লাগল। বলল, এই পরিণতিই হবে, আমি জানতাম! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আর আমাদের পরিবারের পাপ হলো ভয়াবহ বিলাসিতা! এতক্ষণে বুঝতে পারছি, ওই কেবিন কেন থাকছে ও। সন্ন্যাসীর মত থাকার ছুতোয় নিশ্চয় কোন কুকাজ করে বেড়াচ্ছে। হায়রে, জমিদারের ছেলের শেষে এই পরিণতি! জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। টিকেট কেটে লোকে বসে থাকলে বিরক্ত হয়।
তাঁবুর দিকে ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল অ্যানিমেল ট্রেনার।
রবিন বলল, সত্যি কথাই তো বলল বলে মনে হলো। কিশোর, কি মনে হয়, ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও জড়িত নয় তো?
মাথা নাড়ল কিশোর। না, দেখলে না, খবর শুনে সত্যি সত্যি দুঃখ। পেয়েছে। এই লোক কোন খারাপ কাজে জড়িত নয়।
হু, চুপ হয়ে গেল রবিন।
কথা তো বলা হলো, মুসা বলল, এরপর কি কাজ? কি করব এখন? আজও ঢুকব পুমার খেলা দেখতে?
নাহ, এক খেলা কবার দেখে। আর কোন কাজ নেই এখানে। চলো, ব্ল্যাক হোলোতে ফিরে যাই।
ডোবারের ওপর কড়া নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। রাত্রে কি করে লুকিয়ে থেকে দেখবে। কেবিনে ফিরে তাই আর কোন কাজ না পেয়ে, খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে নিল পুরো বিকেলটা। রাতে আবার জাগতে হবে, হয়তো সারারাতই, কে জানে?
সূর্য ডোবার পর তাকে আর রবিনকে ডেকে তুলল মুসা। ডিনার তৈরি করে ফেলেছে।
পেট ভরে খেয়ে নিল তিনজনে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখল, পরিষ্কার, ঝকঝকে আকাশে তারা জ্বলছে। আজ রাতে আর ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠতে দেরি আছে। রাতের অভিযানের জন্যে তৈরি হতে লাগল ওরা। গাঢ় রঙের পোশাক পরে নিল, যাতে অন্ধকারে ভালমত লুকিয়ে। থাকতে পারে।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। শব্দ করে ওদের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিতে পারে, এই ভয়ে ফগকে বেঁধে রেখে এল রান্নাঘরে। হোলোর, পথঘাট এখন মোটামুটি পরিচিত। রাতে টর্চ নিভিয়ে চলতেও আর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। নিরাপদেই চলে এল ডোবারের কেবিনটার কাছে। ঘন অন্ধকারে আবছামত চোখে পড়ল ওটার আকৃতি। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আসছে খুব সামান্য কমলা রঙের আলো।
পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল ওরা।
কথা শোনা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে। ডোবার না একা থাকে বলল, তাহলে কথা বলছে কার সঙ্গে? মনোযোগ দিয়ে শুনে অন্য কণ্ঠটা কার চিনে ফেলল কিশোর, উকিল আনি হুগারফ। অবাক হয়ে ভাবল, এই লোক এখানে কি করছে!