রিভারভিল, জবাব দিল কিশোর। ওখানেই আছে এখন কারনিভ্যালটা। মেইন রোড দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই রাস্তায় গেলে সময় অর্ধেক, লাগবে। আমাদের।
সরু, এবড়োখেবড়ো কাঁচা পথটার জন্যে উপযুক্ত ক্যাপ্টেনের গাড়িটা। সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পথের মাঝে মাঝে গর্ত, আগে থেকে খেয়াল না করলে ওগুলোতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে। দুই ধারে ঘন বন। কখনও নালা এগিয়ে যাচ্ছে পথের সমান্তরালে, কখনও শৈলশিরা। একটা বাড়িঘরও চোখে পড়ল না কোথাও।
কয় মাইল এসেছে মিটারে দেখে নিয়ে কিশোর বলল, আর বোধহয় বেশি দূরে নেই। হায় হায়, ওটার আবার কি হলো? এমন জায়গায় গাড়ি খারাপ হলে তো সর্বনাশ! নিজেদের কথাও ভাবল সে। পথের পাশে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এই মন্তব্য করল সে। গাড়িটার বনেট ওপরে তোলা। দুপাশ থেকে ঝুঁকে তার নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে দু-জন লোক, ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না একজনেরও।
কি হলো দেখা দরকার, কিশোর বলল। বিপদে পড়েছে মনে হয়। দেখি, কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।
কিশোর, সন্দেহ জেগেছে রবিনের, ওরা আমাদের গাড়ি থামানোর। জন্যে এই বাহানা করছে না তো? ক্যাপ্টেনের গাড়ি দেখে হয়তো দেখতে এসেছে, ব্যাপারটা কি?
সেটা কথা না বললে বোঝা যাবে না। ওরা দু-জন, আমরা তিনজন, সাবধান থাকব, তাহলেই কিছু করতে পারবে না।
গাড়ি থামাল রবিন। ওরা তিনজন বেরোতে না বেরোতেই লাফ দিয়ে এগিয়ে এল বিরাট এক কুকুর। গাড়ির ওপাশে ছিল এতক্ষণ।
খাইছে! তাড়াতাড়ি মূসা বলল, এই ফগ বেরোবি না, বেরোবি না, খেয়ে ফেলবে! কিন্তু আকারের তুলনায় কুকুরটা ভদ্র, কৌতূহলী ভঙ্গিতে তার হাত শুকতে লাগল।
সোজা হয়ে দাঁড়াল একজন লোক। হালকা-পাতলা গঠন, লাল চুল। কুকুরটাকে ডাকল, এই মবি, আয় এদিকে। মুসাকে বলল, ভয় পেয়ো না। ও কামড়ায় না।
কি হয়েছে গাড়ির? জানতে চাইল কিশোর।
চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারছি না।
এগিয়ে গেল মুসা। ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একবার দেখি?
গাড়ির কাজ জানো নাকি? জিজ্ঞেস করল উজ্জ্বল রঙের প্রিন্টের শার্ট পরা অন্য লোকটা।
কিছু কিছু।
তাহলে দেখো কিছু করতে পারো কিনা। কি যে বিপদে পড়লাম।
শার্টের হাতা গোটাতে লাগল মুসা, দেখি, টুলস কি আছে দেন?
টুলস বক্স বের করে দিল লালচুল লোকটা।
একটা স্প্যানার নিয়ে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকল মুসা। কয়েক মিনিট পর হাসি মুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যান, ঠিক হয়ে গেছে। কন্ডোরে গোলমাল ছিল।
এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে পারল না লোকগুলো। প্রিন্টের শার্ট পরা লোকটা গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে ইগনিশনে মোচড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট হয়ে গেল গাড়ি।
বিস্ময় দেখা দিল লালচুল লোকটার চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো দেখি গাড়ির জাদুকর হে! কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিঃ বাঁচালে। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
জানা গেল, গাড়িটা একটা স্কুলের। ফরেস্টবার্গে যাওয়ার পথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। তিন গোয়েন্দাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আবার নিজের পথে রওনা হয়ে গেল লোকগুলো।
তারমানে ওরা শত্রুপক্ষ নয় আমাদের? গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন। তুলল রবিন।
মনে হয় না, জবাব দিল কিশোর। আচরণে তো সে-রকম মনে হলো না।
হতে পারে, পেছন থেকে মুসা বলল, ওরা ভেবেছিল, ক্যাপ্টেন রিচটন আছেন গাড়িতে। তাকে দেখলেই অন্য রকম আচরণ করত। আমাদের দেখে আর কিছু করার প্রয়োজন বোধ করেনি…
কি জানি। আমার সে-রকম মনে হয়নি।
তবে ইঞ্জিনে কিন্তু সত্যি গোলমাল হয়েছিল। ওটা বাহানা কিংবা সাজানো নয়।
রিভারভিলে পৌঁছল গাড়ি। তৃতীয়বারের মত হ্যারিজ কার্নিভ্যালে এল গোয়েন্দারা। খেলা শুরু হয়নি এখনও। একজন টিকেট কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, হুমবাকে কোনখানে পাওয়া যাবে।
কর্নেল যে তাঁবুতে খেলা দেখায় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট সাদা রঙের একটা ক্যারাভান ট্রেলার। ওটাতেই থাকে অ্যানিমেল ট্রেনার। ছেলেরা কাছে এসে দাঁড়াতেই খুলে গেল দরজা। বেরিয়ে এল খেলা দেখানোর পোশাক পরা হুমবা।
এগিয়ে গেল কিশোর। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, মিস্টার আরিগন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। একটু দাঁড়াবেন, প্লীজ।
আরিগন নামটা শুনেই থমকে গেছে হুমবা। কিশোর দাঁড়াতে মা বললেও দাঁড়াত। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এই নাম জানলে কি করে তুমি?
আরিগন নামে আরেক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের, চেহারার এত মিল, আপনার ভাই বলেই চালিয়ে দেয়া যায়। খুব ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে দু-জন দুই লোক। যখন জানলাম, ওই ভদ্রলোকের একজন ভাই আছে, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে অসুবিধে হলো না। একটা কথা বুঝতে পারিনি, নুবার কে, আর ডোবার কে?
দ্বিধা করল হুমবা, তারপর বলল, আমি নুবার। সঙ্কোচ বোধ করছে। লোকটা। হাসল, তাতেও সঙ্কোচ। আসলে নিজের পরিচয় দিতেই এখন লজ্জা লাগে, বিলাসিতা করে ফকির হওয়া মানুষদের কেউ দেখতে পারে না। এতে যদিও আমাদের খুব একটা দোষ ছিল না, আমাদের বাবাই দায়ী..যাই হোক, আসল নামটা রাখলে এই এলাকায় বেকায়দায় পড়ে যেতাম, কে যায় লোকের অহেতুক মন্তব্য শুনতে, তাই বদলেই ফেললাম। অনেক আগে চলে গেছি তো আমরা এই এলাকা ছেড়ে, এখন নিজে থেকে পরিচয় না দিলে সহজে কেউ আর চিনতে পারবে না। কিন্তু তোমাদেরকে এত কথা বলছি কেন? তোমরা কারা?