বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল। আলো রইল বেশিক্ষণ। তাতে তিরিশ গজ। দূরের ছুটন্ত মূর্তিটাকে স্পষ্ট নজরে পড়ল তার। বগলে চেপে ধরে আছে কিছু।
পিচার! চিৎকার করে ডাকল সে, দাঁড়াও!
কিন্তু দাঁড়াল না আজব ছেলেটা। হোলোর পাথুরে এলাকার দিকে দৌড় দিল। পায়ে ব্যথা পেয়েছে মনে হলো, অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে, কিন্তু গতি কমছে না। পাথরে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিন্তু সমতল জায়গায় রয়েছে মুসা, তার সঙ্গে পারল না ছেলেটা। কয়েক লাফে কাছে পৌঁছে গেল সে। পা সই করে ঝাঁপ দিল। গোড়ালি ধরে ফেলল ছেলেটার। উপুড় হয়ে পড়ে গেল। পিচার, বগলের নিচ থেকে ছিটকে পড়ল দূরে ফগ, ব্যথা পেয়ে কেউ কেউ করতে লাগল।
চরমে পৌচেছে ঝড়। বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকে আলোকিত করে রেখেছে উপত্যকা।
ছেলেটার গায়ের ওপর চলে এল মুসা, কুস্তির কায়দায় চেপে ধরল। কিন্তু পিচারের গায়েও কম জোর না, তার ওপর ভেজা শরীর, ভেজা হাত, তাকে ধরে রাখতে পারল না মুসা। পিছলে নিচ থেকে সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। একটা বড় পাথর তুলল মারার জন্যে।
নিচ থেকে চিৎকার শোনা গেল, খবরদার, ফেলো ওটা!
চমকে ফিরে তাকাল পিচার, এই সুযোগে গড়িয়ে সরে গেল মুসা। আবার ছেলেটার পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আরেকবার ফেলে দিল মাটিতে।
পৌঁছে গেল রবিন আর কিশোর। তিন জনের সঙ্গে পারল না ছেলেটা, কাবু করে ফেলা হলো তাকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। দু-দিক থেকে দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে দু-জনে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে মুসা। বলল, আমার কুত্তাটা কোথায়? এই ফগ, ফগ?
ডাক শুনে কুঁই কুঁই করতে করতে এসে হাজির হলো বাচ্চাটা। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, ভয় আর ব্যথা ভুলে গিয়ে মুসার পা ঘেষে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। ওটার গলার দড়ি খুলে নিয়ে পিছমোড়া করে হাত বাধা হলো পিচারের। বন্দিকে নিয়ে কেবিনে ফিরে চলল তিন গোয়েন্দা।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলল বুনো ছেলেটা, পালানোর চেষ্টা করল না আর।
ভিজে গোসল করে ওরাও কেবিনে পৌঁছল, বৃষ্টিও থেমে গেল। ঝড়ো বাতাসে মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে দিল আকাশ।
আমার খিদে পেয়েছে, ঢুকেই ঘোষণা করল মুসা। উফ, যা দৌড়ানটা দৌড়েছি!
পেয়েছে তো আর কি, রবিন বলল, খাবার বানাও, মানা করছে কে।
গা মুছে, কাপড় বদলে রান্নাঘরে চলে গেল মুসা। বিরাট এক পাত্রে স্যুপ বসাল। সেই সঙ্গে চলবে স্যামন মাছের স্যান্ডউইচ।
বন্দির বাঁধন খুলে দিয়েছে কিশোর আর রবিন। কিছু শুকনো কাপড় এনে দিয়ে ভেজাগুলো বদলে নিতে বলল।
কেবিনের উজ্জ্বল আলোয় এই প্রথম কাছে থেকে ভাল করে ছেলেটাকে দেখতে পেল গোয়েন্দারা। বয়েস চোদ্দ হবে, তবে সেই তুলনায় অনেক লম্বা, গঠনও বড়দের মত। কালো লম্বা চুল লেপ্টে রয়েছে ঘাড়ে, কপালে, কতদিন কাটে না কে জানে। টারজানের বাচ্চা সংস্করণ মনে হলো ওকে রবিনের কাছে।
কাপড় বদলে চুপ করে বসল পিচার। পায়ে একটা গভীর কাটা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এল কিশোর। কাটাটা আইয়োডিন। দিয়ে মুছে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। বাধা দিল না ছেলেটা। আইয়োডিন লাগানোর সময় যখন ছ্যাৎ করে জ্বলে উঠল জখমটা, তখনও মুখ বিকৃত করল না। ভয় অনেকটা দূর হয়ে গেছে চোখ থেকে, বুঝে গেছে তার কোন ক্ষতি করবে না কিশোররা।
ট্রে বোঝাই খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল মুসা। হাসিমুখে কয়েকটা স্যান্ডউইচ আর একবাটি স্যুপ এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও পিচার, খেয়ে ফেলো।
দ্বিতীয়বার আর বলতে হলো না, গপ গপ করে গিলতে শুরু করল পিচার। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলল। আরও কিছু খাবার তার দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। হেসে বলল, বাহ, আমার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মত একজনকে পাওয়া গেল।
পিচার আর মুসাকে খাওয়ায় ব্যস্ত রেখে ইশারায় রবিনকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। নিচু স্বরে বলল, ছেলেটাকে একটুও বিপজ্জনক লাগছে না আমার কাছে। কাল নদীর ধারে আমাদের ওপর চোখ রেখেছিল। যে, সে পিচার নয়। ওই লোকটা এর মতই লম্বা, তবে চেহারা মেলে না, অন্য রকম।
একমত হয়ে মাথা কঁকাল রবিন। আমরা তো আর সন্দেহ করিনি, আরিগন বলেছেন পিচার হতে পারে।
আর কিছু বলার সুযোগ পেল না ওরা, পিচারকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। মুসা। ফগকেও খাবার দেয়া হয়েছে। তাকে আদর করতে লাগল মুসা।
স্টোভের আগুনে গরম হয়ে উঠেছে রান্নাঘর, বেশ আরাম। বৃষ্টিতে ভিজে এসে শুকনো কাপড় পরে, পেট ভরে খাওয়ার পর বুনো ভাবটা চলে গেছে পিচারের মুখ থেকে। মুসা আর ফগের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসল, বুঝিয়ে দিল কুকুর ভালবাসে সে।
কিশোর ভাবল, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু পিচার বোবা, জবাব তো দিতে পারবে না, কি করে বলবে? শেষে বসার ঘরে চলে গেল। কিশোর, কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে এল। ছেলেটার হাতে দিয়ে বলল, আমি কয়েকটা কথা জানতে চাই, জবাব দেবে?
ওদের ব্যাপারে ভীতি আর সন্দেহ চলে গেছে পিচারের। মাথা ঝাঁকাল।
বেশ, ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে বলল কিশোর, বলো, আমাদের কুকুরটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলে কেন?
বিস্ময় ফুটল ছেলেটার চোখে। টেবিলে কাগজটা বিছিয়ে নিয়ে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করতে লাগল। লম্বা, চওড়া কাধ একজন মানুষের চেহারা ফুটে উঠল কাগজে। ভুরু আর গোঁফ ভারি করে দিল সে।