তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিৎকার করে উঠল মুসা, এই দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাব তোমাদের! ভুলেই গিয়েছিলাম! পকেট থেকে একটা ধাতব চাকতি বের করে টেবিলে ফেলল সে।
কি জিনিস? হাতে নিয়ে একবার দেখেই ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের, আরি এ তো কুকুরের গলার ট্যাগ! ডবের নাম! পটির কুকুর! কোথায় পেলে?
আরিগনের বাড়ির দরজার সামনে, ঘাসের ওপর।
তবে কি আরিগনই কুকুর চুরি করছেন? আগ্রহে বকের মত সামনে গলা বাড়িয়ে এসেছে রবিন, কিশোরের হাতের তালুতে রাখা ট্যাগটা দেখছে। কোন ধরনের অপরাধে জড়িত? নিজেই তো বললেন, এই এলাকায় একটা বেআইনী কুকুরের মার্কেট আছে।
কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর। ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে রহস্য। তাঁর বাড়িতে কুকুরের ছায়াও তো দেখলাম না।
তার ভেড়ার খোয়াড়টা দেখে এসেছি আমি, মুসা জানাল, ভেড়া নেই, অন্য কোন প্রাণীও নেই। এমন হতে পারে, ডব গিয়ে বাড়িটার সামনে ঘুরঘুর করছিল, ওই সময় কোনভাবে তার গলা থেকে খুলে পড়ে যায় ট্যাগটা।
চুকচুক শব্দ করে দুধ খেতে লাগল ফগ। সেদিকে তাকিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, আজ রাতেই ফাঁদ পাতব।
রাখবে কোথায়?
বারান্দার নিচে, বেঁধে। দরজার কাছে লুকিয়ে থাকবে তুমি আর রবিন। আমি থাকব বাইরে, বাড়ির কোণে। যেদিক থেকেই আসুক চোর, আমাদের চোখে না পড়ে যাবে না।
রাত দশটায় আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল ছোট্ট কেবিনটা। আকাশে মেঘ করেছে। বাতাস গরম। নিথর হয়ে আছে প্রকৃতি। ঝড়ের সঙ্কেত জানাচ্ছে।
নিঃশব্দে দরজা খুলে ফগকে নিয়ে বেরোল মুসা। বারান্দার রেলিঙের সঙ্গে বাঁধল কুকুরটার গলার দড়ি। ঘরে ফিরে গেল আবার। পাল্লাটা খোলা রেখে দুপাশে বসে পড়ল সে আর রবিন।
অন্ধকারে যাতে দেখা না যায়, এ জন্যে গাঢ় রঙের পোশাক পরে বেরোল কিশোর। ক্যাপ্টেনের গাড়ি আর ঘরের দেয়ালের মাঝের ফাঁকে লুকিয়ে বসল, চত্বরের কাছ থেকে কয়েক কদম দূরে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কান খাড়া। ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। তারপরেও বন থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এগিয়ে আসে, তাকে দেখতে পাবে না পেছনে গাছগুলো কালো হয়ে থাকায়।
ক্রমেই যেন আরও ভারি, আরও গরম হয়ে উঠছে বাতাস। দিগন্তে ঝিলিক দিতে আরম্ভ করল বিদ্যুতের সরু সরু শিখা। গুমগুম আওয়াজ বেরোতে থাকল মেঘের ভেতর থেকে। হঠাৎ পুরো আকাশটাকে চিরে দিয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল বিদ্যুৎ, ক্ষণিকের জন্যে সবকিছুকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করেই নিভে গেল, অন্ধকারকে ঘন করে তুলল আরও। দশদিক কাঁপিয়ে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল।
ঘড়ি দেখল কিশোর। এখন মধ্যরাত।
আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বজ্রপাতের শব্দ আগের বারের চেয়ে দীর্ঘায়িত হলো। বারান্দার নিচে ভীতকণ্ঠে কুঁই কুঁই করতে লাগল বাচ্চাটা।
ঝড়ের আর দেরি নেই, ভাবল কিশোর।
আবার বিদ্যুতের চমক, আবার বজ্রপাত…তার পর পরই বড় বড় ফোঁটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টিপাত। আচমকা গোঙানো বাদ দিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ফগ। কয়েকটা চিৎকার দিয়েই থেমে গেল, মুখ চেপে ধরা হয়েছে যেন, যাতে ডাকতে না পারে।
ঝড় মুহূর্তের জন্যে অমনোযোগী করে দিয়েছিল তিনজনকেই, কুকুরটার ওপর নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিল, এই সময়টুকুতেই ঘটে গেল ঘটনাটা। ম্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে দৌড়ে এল মুসা ও রবিন, বাড়ির পাশ থেকে ছুটে
এল কিশোর।
দেখল, ফগ নেই!
মুখ চেপে ধরলেও বাচ্চাটার গোঙানি শোনা যেত, কিন্তু ঝড়ের শব্দ ঢেকে দিল সেটা। বিদ্যুৎ চমকাল, তীব্র নীলচে আলোয় আলোকিত করে দিল বনভূমি, সেই আলোতে তিনজনেরই চোখে পড়ল হোলোতে নামার পথটা ধরে ছুটে যাচ্ছে একটা মূর্তি।
ধরো ওকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।
টর্চ হাতে ছুটল তিনজনে।
.
১০.
কয়েক লাফে খোলা জায়গাটুকু পেরিয়ে বনে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা। টর্চের আলো থাকা সত্ত্বেও গতি কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হলো। বৃষ্টিতে ভেজা ঢালু এই পথ ধরে জোরে ছোটা ওদের পক্ষে অসম্ভব।
সামনে অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়ে চলেছে কুত্তাচোর। তার চলা দেখেই অনুমান করা যায়, এই এলাকা তার অতিপরিচিত। ফগের চিৎকার শোনা গেল আবার, তার মুখ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ঝরছে বৃষ্টি। বিদ্যুতের আলোয় প্রায় তিরিশ গজ নিচে ছুটন্ত মূর্তিটাকে দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা।
হঠাৎ অন্ধকারে মানুষের আর্তনাদ শোনা গেল। ডান দিকে পাথরের মধ্যে একটা ভারি কিছু গড়িয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে বোধহয় থেমেছিল, আবার শোনা যেতে লাগল ছুটন্ত পায়ের শব্দ।
কিশোর, তোমরা দেখো তো কি হলো! আগে আগে ছুটতে ছুটতে বলল মুসা। আমি চোরটার পিছে যাচ্ছি!
টর্চের আলো ফেলে ঘন ঝোপের দিকে দৌড় দিল কিশোর আর রবিন। ঝোপঝাড় ভাঙার শব্দেই বোঝা গেল তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে কেউ। কিন্তু আর গোঙানি কানে এল না। খানিক পর ঝড়বৃষ্টির শব্দ ছাড়া শোনা গেল না আর কিছুই।
পালিয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন। ধরতে পারব না।
মুসা ওদিকে গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নেমে যাচ্ছে উপত্যকায়। টর্চ হাতে থাকলেও ওই আলোয় পথ দেখে দৌড়াতে অসুবিধে, কারণ দৌড়ানোর। সময় নাচানাচি করে আলো, এ জন্যে নিভিয়ে দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় যতটা পারা যায় দেখে দৌড়াচ্ছে। পথটা তারও মোটামুটি চেনা।