বিপদ থেকে উদ্ধারের কোন পথই দেখছে না দুই গোয়েন্দা, এই সময় টাশশ করে উঠল পিস্তল। ছোবল মারতে তৈরি হয়েছিল যে সাপটা, নিমেষে গায়েব হয়ে গেল ওটার মাথা। শরীরটা পাথরে আছড়ে পড়ে মোচড় খেতে লাগল। গুলির শব্দে ভাঁড়কে গিয়ে পালাতে শুরু করল অন্য দুটো।
জলদি সরে এসো ওখান থেকে। চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
শৈলশিরা ধরে যত দ্রুত সম্ভব গর্তের কাছ থেকে সরে গেল মুসা আর রবিন। ওদের কাছে উঠে এলেন আরিগন আর কিশোর। আরিগনের পিস্তলের নল থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
ওরা চারজন নিরাপদে মাটিতে নামার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শেরিফ। ভুরুর ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ওখানে যাওয়াটা উচিত হয়নি তোমাদের! গলা কাঁপছে তার।
এক্কেবারে সময়মত গুলিটা করেছিলেন, মিস্টার আরিগন, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রবিন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি থাকাতে আজ বাঁচলাম।
হাসি মুছে গেছে আরিগনের মুখ থেকে। গম্ভীর স্বরে বললেন, এখানে আমি ছিলাম বলে রক্ষা, এটা অন্য কোথাও ঘটতে পারত। সাবধান না হয়ে অত তাড়াহুড়ো করে গর্তের কাছে যাওয়া উচিত হয়নি তোমাদের। অচেনা জায়গায় আরও দেখেশুনে যেতে হয়।
আন্তরিক ভঙ্গিতে একটা হাত মুসার কাঁধে, আরেক হাত রবিনের কাঁধে রাখলেন তিনি। শোনো, আমি যা বলি মন দিয়ে শোনো। বনে চলার অভিজ্ঞতা নেই তোমাদের, বুঝতে পারছি। এখানে আরও অনেক সাবধান থাকতে হয়। কোথায় যে কোন বিপদ ঘাপটি মেরে থাকে কল্পনাও করতে পারবে না। এই সাপগুলোর কথাই ধরো না, ওরা যে ওখানে আছে ভাবতে পেরেছিলে? অথচ ভাবা উচিত ছিল। গর্তের কাছে পাথুরে জায়গায় শুয়ে রোদ পোয়ায় সাপেরা, কাজেই গর্তের কাছে যাওয়ার আগে সাবধান থাকতে হয়। বুনো এলাকা এটা, এখানে বনের ভেতরে যেমন বিপদ, বাইরেও বিপদ।
তার কথায় সায় জানাল একজন ডেপুটি।
আরেকজন নীরবে মাথা ঝাঁকাল।
শেরিফ বললেন, বনের মধ্যে এ ধরনের বিপদে আনাড়ি লোকেরাই সাধারণত পড়ে। শহরে বাস করা মানুষকে এনে এই পর্বতের মধ্যে ছেড়ে দিলে মুহূর্তে পথ হারিয়ে বসে থাকবে। বেরোতেই পারবে না আর।
হাসি ফুটল আবার আরিগনের মুখে, হালকা হয়ে এল কণ্ঠস্বর, যাই হোক, বুদ্ধিমান লোকেরা একবারই বোকামি করে। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি বুঝতে পারছি তোমরা বুদ্ধিমান। আশা করব, ব্ল্যাক হোলোর ধারেকাছেও আসবে না আর। এখানে পদে পদে বিপদ যে ওঁত পেতে থাকে, নিজের চোখেই তো দেখলে।
ক্যাপ্টেন রিচটনকে খোঁজার এখানেই ইতি হলো। আরিগন, শেরিফ আর তাঁর তিন ডেপুটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে হতাশ হয়ে কেবিনে ফিরল তিন গোয়েন্দা। সাপের কবল থেকে বাঁচার পর থেকেই শরীরটা দুর্বল লাগছে। রবিনের, ধপ করে শুয়ে পড়ল বাংকে। কুকুরের বাচ্চাটাকে কিছু খাবার দিয়ে। মুসা গেল রান্নাঘরে। আবার রিচটনের ক্যালেন্ডারটা নিয়ে বসল কিশোর। দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে।
শিক কাবাব, পটেটো চিপস আর ভেজিটেবল সুপ রান্না করে সবাইকে খেতে ডাকল মুসা। তখনও চুপ করে আছে রবিন। কিশোর গম্ভীর। এই পরিস্থিতি ভাল লাগল না মুসার। হালকা করার জন্যে বলল, ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি তোমাদের?
মুখ তুলল কিশোর, কোনটা?
এই যে খোকাবাবু মনে করে আমাদের লেকচারটা দিয়ে দিলেন আরিগন। আমার তো রাগই হচ্ছিল। বনেবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে ঝানু হয়ে গেলাম, আর আমাদের কিনা বলে বন চিনি না। আরে বাবা ক্যাম্প করেই তো থাকলাম কত শতবার।
চিবাতে চিবাতে রবিন বলল, আমারও ভাল লাগেনি। কিছু বললাম না, আমাদের প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে। গাধামি তো সত্যিই করেছি আমরা।
কিশোর বলল, না, সেটা আমাদের দোষ নয়। নাহয় ধরলামই আমরা আনাড়ি, বন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই, কোথায় সাপ শুয়ে রোদ পোহায়, জানি না, কিন্তু আরিগন তো জানতেন। আর জানতেনই যদি আমাদের ওখানে যেতে বললেন কেন?
তাই তো, এভাবে তো ভাবিনি! চিবানো বন্ধ করে দিল রবিন। ক্যাপ্টেনকে খোঁজা বন্ধ হয়ে গেল…আমাদের হোলোতে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন…কিশোর, যা-ই বলো, ওই বাড়িটা যেমন রহস্যময়, তার মালিকও তেমনি রহস্যময়। একটা দরজা বন্ধ হতে শুনেছি আমি, অথচ রান্নাঘরে ঢুকে আর কোন দরজা চোখে পড়েনি।
ব্যাপারটা আমারও খটকা লেগেছে। একমুহূর্ত চুপ করে ভাবল কিশোর। তারপর বলল, ইচ্ছে করেই সাপের বাসায় আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওখানে সাপ আছে জানেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল নিয়ে এসেছেন, যাতে গুলি করতে পারেন। এ সব করে শেরিফকে বোঝাতে চেয়েছেন, কয়েকটা নির্বোধ, অপোগণ্ড ছেলে আমরা, আমাদের কথায়। ভবিষ্যতে কান না দেয়াই উচিত।
আচ্ছা, মুসা বলল, আমাদের খুন করতে চায়নি তো? সাপে কামড়ে আমাদের মেরে ফেললে কারও দোষ হত না। শেরিফ আর তার ডেপুটিদের চোখের সামনে ঘটত ব্যাপারটা। কোন রকম সন্দেহ জাগত না কারও মনে।
কি জানি, বুঝতে পারছি না, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কিশোর।
আরও একটা প্রশ্ন, পিচার আমাদের পাথর ছুঁড়ল কেন? সে-ও কি আরিগনের দলের লোক?
না-ও হতে পারে। সাপের গুহার দিকে এগোচ্ছি দেখেও ছুঁড়তে পারে, আমাদের ঠেকানোর জন্যে। তবে শিওর হতে পারছি না।
ভুরু কুঁচকে রবিন বলল, এই আরিগন লোকটা এক বিরাট রহস্য হয়ে দাঁড়াল! কর্নেল হুমবার সঙ্গে অবিকল মিল, এটাই বা হয় কি করে? যমজ ভাই নাকি…