সবাইকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন শেরিফ। প্রতিটি লোক তার ডান পাশের লোককে নজরের মধ্যে রাখবে। তাহলে দলছুট হয়ে পড়ার ভয় থাকবে না কারও।
ফগকে নিয়ে মুসা রইল দলটার ঠিক মাঝখানে। সারির বা প্রান্তের শেষ লোকটি হলেন শেরিফ, ডান প্রান্তে কিশোর। তার পাশের লোকটি রবিন। মুসার পাশে আরিগন। ঘন বনে ক্যাপ্টেন রিচটনের খোঁজ চালাল সার্চ পার্টি।
লতায় ছাওয়া ঝোপঝাড়, স্বল্প আলো, আর ঘন হয়ে জন্মানো বড় বড় গাছ বাধা দিয়ে কঠিন এবং ধীর করে তুলল খোঁজার কাজ।
শেরিফ! চিৎকার করে বললেন আরিগন, আপনার সামনে একটা খাত পড়বে। ওটাতে ভাল করে দেখবেন। হাড়গোড় ভেঙে ওতে পড়ে থাকতে পারেন ক্যাপ্টেন।
এক মিনিট পরেই জবাব এল, নেই এখানে।
খানিক পরে রসিকতার সুরে কিশোরদের বললেন আরিগন, তোমাদের সামনে একটা বড় গাছ পড়বে। তাতে মস্ত ফোকর। ভাল করে দেখো, ওর মধ্যে লুকিয়ে বসে আছেন কিনা তোমাদের বন্ধু।
আরিগন ব্যাপারটাকে এত হালকা ভাবে নিয়েছেন দেখে রাগ হতে লাগল কিশোরের। রবিনেরও ভাল লাগছে না এ ধরনের আচরণ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাটি আর আশপাশের সব কিছু দেখতে দেখতে চলেছে দু-জনে। মূসা আর ফগও খুব সতর্ক।
বিষণ্ণ বনের মধ্যে চলল একঘেয়ে খোঁজার কাজ। হঠাৎ কোন কিছু চমকে দিল ফগকে, সামনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার শুরু করল।
মানুষ! চেঁচিয়ে বলল মূসা, একটা লোক পড়ে আছে!
দুই পাশ থেকে দৌড়ে এল সবাই। হাত তুলে দেখাল-মুসা। সবাই দেখল, আবছা অন্ধকার বনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে কালো কোট, কালো টুপি আর ধূসর ট্রাউজার পরা একটা দেহ।
সবার আগে ছুট লাগাল ফগ। তার পেছনে দৌড় দিল সবাই। পড়ে থাকা দেহটার কাছে আগে পৌঁছল তিন গোয়েন্দা।
দূর! মানুষ কোথায়? হতাশ কণ্ঠে বলে উঠল রবিন, ক্যাপ্টেনের লাশ দেখতে হয়নি বলে খুশিও হয়েছে, এ তো গাছ!
রসিকতা করে ফগকে বললেন আরিগন, কেমন কুত্তারে তুই? গাছকে মানুষ ভেবে বসিস?
কিন্তু সে যে মানুষ ভেবে চিৎকার করেনি তার আচরণেই বোঝা গেল। ছোঁক ছোঁক করছে গাছটার কাছে। নাক নামিয়ে শুকছে। ইঁদুর বা বেজি জাতীয় কোন প্রাণীর গন্ধ পেয়েছে মনে হয়, খোড়লে ঢুকে পড়েছে ওটা।
ওর আর দোষ কি? আমরাও তো ভেবেছি, মুখ কালো করে বলল একজন ডেপুটি। নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল অন্য দুজন।
দূর থেকে কিন্তু এক্কেবারে মানুষ মনে হয়েছে, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মুসা। এমন একটা ভুল করাতে লজ্জা লাগছে তার।
শেরিফ বললেন, থামি এখানে। একটু জিরিয়ে নিই।
খুশিমনে ব্যাগ খুলে খাবার বের করতে লাগল মুসা। হাতে হাতে তুলে দিল টিউনা মাছ, ডিমের সালাদ, আর ভেড়ার মাংস ও পনিরে তৈরি স্যান্ডউইচ। যে গাছের গুঁড়িটা বোকা বানিয়েছে ওদের, তার ওপর বসেই চিবাতে লাগল তিন ডেপুটি। নিচে বসল তিন গোয়েন্দা ও শেরিফ। খানিক দূরে একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বসেছেন আরিগন।
ঘড়ি দেখে মুখ বাকিয়ে শেরিফ বললেন, এখন যে দুপুর, বনের মধ্যে এই অন্ধকার দেখলে কে বিশ্বাস করবে!
খাওয়ার পর আবার উঠে আগের মতই ছড়িয়ে গেল দলটা। আবার চলল খোঁজা। বিকেল নাগাদ বনে ছাওয়া উপত্যকার নিচেটা পুরো দেখা হয়ে গেল। পাওয়া গেল না কিছু। বন থেকে বেরোতে সামনে পড়ল হোলোর পাথুরে দেয়াল।
ওই যে ওখানে একটা গুহা আছে, হাত তুলে একটা পাথরের চাঙড় দেখিয়ে বললেন আরিগন। ওর মধ্যে পড়ে থাকলে অবাক হব না। গোয়েন্দাদের বললেন, তোমরা যাও। উঠে গিয়ে দেখো। আমি পেছনেই আছি। পা-টাতে যে কি হলো আজ, চাপই দিতে পারছি না।
তরতর করে উঠে যেতে লাগল রবিন। তার পেছনে মূসা, সবশেষে কিশোর। কিছুদূর উঠেই গুহার কালো মুখটা নজরে এল। পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা শৈলশিরা। খাড়া ঢাল থেকে ওটার ওপর সবে নিজেকে টেনে তুলেছে রবিন, এই সময় শাঁ করে কি যেন একটা চলে গেল তার কানের পাশ দিয়ে।
খবরদার! তোমার ওপরে! নিচ থেকে চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।
একের পর এক পাথর ছুটে আসতে লাগল ছেলেদের দিকে। কিন্তু। কোনটাই গায়ে লাগল না। অল্পের জন্যে মিস হতে লাগল। মুখ তুলে ওরা দেখল, লম্বা, পাতলা একটা মূর্তি উঁকি দিয়ে আছে দেয়ালের একেবারে কিনার থেকে। পাথরগুলো সে-ই ছুড়ছে।
পিচার! ও-ই পিচার! আবার চিৎকার করে উঠলেন আরিগন।
মুঠো পাকিয়ে ওপর থেকে হাত ঝাঁকাতে লাগল বোবা ছেলেটা। কিশোরের মনে হলো, কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সরে যেতে বলছে যেন।
ওপরে উঠতে মানা করছে আমাদের, রবিন বলল। কে শোনে তার কথা! আমরা উঠবই, দেখি কি করতে পারে!
পাথর ছুঁড়েও ঠেকাতে না পেরে যেন হাল ছেড়ে দিল ছেলেটা। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
গর্তের কাছাকাছি চলে এসেছে রবিন আর মুসা। কিনারে এসে ভেতরে তাকিয়েই থমকে গেল। ধড়াস করে উঠল বুক।
মাত্র তিনফুট দূরে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত একটা র্যাটল স্নেক। ছোবল হানতে প্রস্তুত। চোখের পলকে পাথরের আড়াল থেকে ওটার কাছে চলে এল আরও দুটো সাপ। উদ্দেশ্য ওগুলোরও ভাল না!
.
০৯.
ঝট করে যে পিছিয়ে যাবে ওরা, তারও উপায় নেই, শৈলশিরাটা এতই সরু। আটকে দিয়েছে ওদেরকে ভয়াবহ সরীসৃপগুলো। খাড়া ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে সরে যাওয়া যাবে না, তার আগেই ছোবল খেতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গেলে আরও বিপদ আছে, হাত ফসকে যেতে পারে, তাহলে আছড়ে পড়তে হবে অনেক নিচের পাথরে। ভাল বিপদেই পড়া গেছে! ওদিকে লেজের খড়খড় আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসছে অন্য দুটো সাপ। যে কোন মুহূর্তে কামড়ে দেবে।