প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে নিচু দরজাটা পেরিয়ে অন্যপাশে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। জানালাবিহীন ছোট একটা ঘর, দুটো লণ্ঠন জ্বলছে। ঠাণ্ডার সময় ঘর গরম রাখার জন্যে ছোট একটা স্টোভ আছে। চুলায় কফির পানি ফুটছে। কেটলি থেকে কাপে কফি চলতে গেলেন আরিগন।
আমি এখানে ক্যাম্প করেই আছি বলতে পারো, বললেন তিনি। ছোট একটা টেবিল ঘিরে বসেছে সবাই। এখানে বিশ্রাম নিতে আসি। ইচ্ছে হলে ভেড়াটেভা পালি। খুব শান্তির জায়গা।
তা বটে, স্বীকার করল মুসা। একেবারেই নিরিবিলি।
আরও একটা ব্যাপার, পাগলামিও বলতে পারো। সন্ন্যাসীরা কেমন করে বাস করে, একা থাকতে কেমন লাগে তাদের, জানার খুব আগ্রহ আমার। সে জন্যেই এখানে এসে নিজের ওপরই পরীক্ষা চালাচ্ছি। এ ছাড়া জানার আর তো কোন উপায় নেই।
এই কেবিনটা আমার খুব পছন্দ। আশপাশটা কি চমৎকার দেখেছ? পেছনের দেয়াল একেবারে অরিজিন্যাল, নকল-টকল নয়। নিরেট পাথর। এই কেবিনটাও অনেক পুরানো, একশো বছরেরও বেশি। সে-সময় কি ঘটছিল এই এলাকায়, জানো?
স্মৃতি ঘেঁটে তথ্য বের করার চেষ্টা চালাল রবিন, সে-সময়? নিশ্চয় গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাই না?
হ্যাঁ। পড়ালেখা করো তুমি, বোঝা যাচ্ছে। তখন এটা ছিল স্মাগলারদের একটা ঘাটি। মানুষ চোরাচালান করত ওরা। পালিয়ে আসা গোলামরা লুকিয়ে থাকত এখানে, তারপর তাদের পাচার করে দেয়া হত কানাডায়। এ জন্যেই এত লুকোছাপা, পাহাড়ের দেয়াল ঘেষে তৈরি, জানালা নেই, রাতে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আলো যাওয়ারও পথ নেই। জায়গাটা ছোট হতে পারে, কিন্তু খুব নিরাপদ, আরামদায়কও বটে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে আর ভাবছে কিশোর: বিচিত্র এই ছোট্ট কেবিনটাতে মাত্র একটা দরজা, সামনেরটা; তাহলে কোন গোলাম যদি এসে লুকিয়ে থাকে এখানে, তারপর দেখে তাকে ধরতে আসা হচ্ছে, পালাবে কোন পথে? এমন একটা জায়গায় কি লুকাতে চাইবে ওরা যেখান থেকে পালানোর গোপন পথ থাকবে না? তা ছাড়া খানিক আগে যে আরেকটা দরজা লাগানোর আওয়াজ শুনল, সেটা কি সত্যি শুনেছে, না তার কল্পনা?
ঠিক এই সময় থাবা পড়ল সামনের দরজায়।
.
০৮.
দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে রোদ আসা আটকে দিল একটা মোটাসোটা শরীর। লম্বা মানুষটাকে দেখে বললেন, মর্নিং, মিস্টার আরিগন। অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়লাম, সরি। আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।
রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। গলা শুনেই চিনতে পেরেছিল আগন্তুককে, শেরিফ টোনার। ওদের দেখে বলে উঠলেন, ও, তোমরা আগেই চলে এসেছ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আরও তিনজন। লোক। এই যে, তোমাদের সার্চ পার্টি নিয়ে এলাম। তিনজনের বেশি। পারলাম না, এই দিয়েই কাজ চালাতে হবে। তবে তোমরা তিন, মিস্টার আরিগন, আর আমরা মিলে আটজন হয়ে যাচ্ছি, কম না, কি বলো? একটা কুত্তা থাকলে আরও ভাল হত।
আছে, মিস্টার টোনার, মুসা জানাল। আমাদের ফগ।
কালই কিনলাম বিগলের বাচ্চাটা, রবিন বলল।
সার্চ পার্টি কেন, শেরিফ? জানতে চাইলেন আরিগন, সিরিয়াস কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে?
দ্রুত একবার আরিগনের হাসি হাসি মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন শেরিফ, কেন, ছেলেরা কিছু বলেনি আপনাকে?
বলেছে। ওদের এক ক্যাপ্টেন বন্ধুর নাকি খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ধারণা, বনের মধ্যে লম্বা সফরে বেরিয়েছে। সার্চ পাটি নিয়ে খোদ শেরিফ এসে হাজির হয়ে যাবেন তাকে খুঁজতে, এতটা সিরিয়াস ভাবিনি, হেসে কথাটা শেষ করলেন আরিগন।
ভ্রূকুটি করলেন শেরিফ-যেন বলতে চাইছেন, আরও কত জরুরী কাজ ফেলে এসেছি সেটা তো জানেনই না! কিন্তু বললেন না। কিশোর আর রবিন বুঝতে পেরে চট করে তাকাল পরস্পরের দিকে। ঘাবড়ে গেল, মত বদলে শেষে না খোঁজা বাদ দিয়েই চলে যান।
কিন্তু তা করলেন না তিনি, শান্তকণ্ঠে বললেন, মিস্টার আরিগন, এই এলাকা সবচেয়ে ভাল চেনেন আপনি, আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব।
নিশ্চয় করব। খুঁজতেই যখন এসেছেন, আমার এই ঘরটা থেকেই শুরু হোক। কারণ একসময় লুকানোর জায়গা হিসেবেই ব্যবহার করা হত এটাকে। আপনি আসার আগে ছেলেদের এই গল্পই শোনাচ্ছিলাম।
শেরিফকে রান্নাঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন আরিগন, ছেলেরা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল। চুপ করে বসে না থেকে তিনজন ডেপুটির সঙ্গে পরিচয়ের পালাটা শেষ করে ফেলল ওরা।
বাচ্চাটা কি করছে দেখার জন্যে বাইরে বেরোল মুসা। ভেড়ার খোয়াড়ের কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ওটা। ওটাকে ডেকে ফিরিয়ে আনতে যাবে, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘাসের ওপর। কি যেন একটা চকচক করছে। তুলে নিয়েই থমকে গেল, কুঁচকে গেল ভুরু। রেখে দিল পকেটে।
শেরিফ আর অন্যদের নিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন আরিগন। মাথায় নরম হ্যাট। সামনের দিকটায় উজ্জ্বল রঙের একটা প্লাস্টিকের প্রজাপতি বসানো। ছেলেদের দেখিয়ে দেখিয়ে লম্বা নলওয়ালা, কারুকাজ করা সাদা বাঁটের একটা পিস্তল জলেন কোমরের বেল্টে, যেন খুব মজা পাচ্ছেন। হেসে বললেন, জীবনে কখনও ডেপুটি হওয়ার সুযোগ পাইনি।
সার্চ পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন তিনি। তাঁর নির্দেশিত পথেই চলতে লাগল সবাই।
কিছুদূর এগিয়ে মুসাকে বললেন, কুত্তাটাকে নিয়ে তুমি আগে আগে থাকো। গন্ধেই অনেক কিছু বুঝতে পারবে ওটা। সবার উদ্দেশ্যে জ্ঞান। বিতরণ করলেন, দুই ধরনের তরাই আছে ব্ল্যাক হোলোতে, নিচে বন, আর ঢালের গায়ে পাথর। প্রথমে বনে ঢুকব আমরা, সেখানে কিছু না পেলে পাথুরে এলাকায় খুঁজতে যাব।