কেবিনের দরজা খোলা দেখে একছুটে বেরিয়ে যেতে চাইল কুকুরের বাচ্চাটা, কিন্তু হ্যাঁচকা টান লেগে আটকে গেল। দড়ির একমাথা তার গলায় বাধা, আরেক মাথা মুসার হাতে ধরা। পিঠে বাঁধা একটা ব্যাগ। এই ফগ,. জোরাজুরি করিসনে। ব্যথা পাবি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল রবিন। ফগ? বাচ্চাটার নাম রাখলে নাকি?
হ্যাঁ, সকালে কুয়াশা দেখেই নামটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
ভাল। বেশ ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে একটা ভাব আছে।
কেবিনের পাশের খাড়া সেই পথটা ধরে আবার নিচে নামতে শুরু করল। গোয়েন্দারা। আগের দিনের মতই নিথর, নীরব হয়ে আছে চারপাশের বন। ওর মধ্যে যাওয়ার ইচ্ছে এমনকি কুকুরটারও নেই, প্রজাপতি কিংবা ফড়িঙ খুঁজতেও নয়।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিলোর। নিচু স্বরে বলল, কালকের মতই অনুভূতি হচ্ছে! মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিয়েছে আমাদের।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল তিনজনে। কিন্তু কিছুই শোনার নেই। আবার হাঁটতে লাগল ওরা। নিজেদের অজান্তেই যেন চলে এল সেই ঘরটার কাছে। দরজায় থাবা দিল কিশোর।
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। দেখা দিল একজন লম্বা, চওড়া কাঁধ, ভারি ভুরু, পুরু গোঁফওয়ালা নোক। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল গোয়েন্দাদের দিকে।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল রবিনের, কর্নেল হুমবা!
কর্নেল? ভারি কণ্ঠস্বর মানুষটার। জীবনেও কখনও আর্মিতে ছিলাম না, ওই র্যাঙ্ক পাব কি করে?
তারমানে, তোতলাতে শুরু করল মুসা, আ-আপনি বলতে চাইছেন, আপনি কর্নেল ডুম হুমবা নন? অ্যানিমেল ট্রেনার?
ভারি গলায় হাহ হাহ করে হাসলেন তিনি। ওসব কিছুই না আমি। আমি অতি সাধারণ ডোবার আরিগন।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোর। সাধারণ পোশাকে আবার কিছুটা অন্যরকম লাগছে তাকে, ভেড়া কেনার সময় যেমন লেগেছিল। বলল, মিস্টার হুম…সরি, আরিগন, আপনাকেই খুঁজছি আমরা। ক্যাপ্টেন রিচটন নামে একজনের ওখানে বেড়াতে এসেছি, কিন্তু তাকেই পাচ্ছি না। দুই রাত ধরে। তিনি নিখোঁজ।
হাসিখুশি মুখটা মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল আরিগনের। এসো, ভেতরে এসো।কুত্তাটাকে আনার দরকার নেই, বাইরে রেখে এসো।
ছোট একটা ঘরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পুরানো কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিল আছে। আরিগন বললেন, দরজাটা খোলা রাখো, নইলে অন্ধকার লাগবে। তোমরা বসো, আমি আসছি। মাথা নুইয়ে নিচু একটা দরজা দিয়ে ওপাশের রান্নাঘরে চলে গেলেন। বালতি নড়ার শব্দ হলো, দরজা বন্ধ হলো যেন একটা, তারপর ফিরে এলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলো এবার। ক্যাপ্টেন রিচটন কে, তার কি হয়েছে, সব শুনতে চাই।
আগে নিজেদের পরিচয় দিল ছেলেরা। তারপর রবিন জানাল, তিনি আমাদের একজন বন্ধুর বন্ধু। আমরা চিঠি দিয়েছিলাম, আসছি। কিন্তু এসে দেখি তিনি নেই। একেবারে উধাও। এই হোলোতে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। তার ভাঙা টর্চটা পেয়েছি বনের মধ্যে, আর দুটো শটগানের গুলির খোসা। তিনিই ফায়ার করেছেন সম্ভবত।
হ্যাঁ, আরিগন বললেন, সেদিন রাতে গুলির শব্দ শুনেছি। প্রথমে ভাবলাম কেউ শিকার করতে এসেছে। এখানে কেবল কুন শিকারের অনুমতি আছে, আর কুন শিকার করতে কুকুর সঙ্গে আনে শিকারীরা। কিন্তু কুকুরের ডাক শুনলাম না। তখন ভাবলাম চুরি করে হরিণ মারতে ঢুকেছে কেউ। নাহ্, তোমাদের বন্ধুর কথা জানি না, কি হয়েছে বলতে পারছি না। সরি।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, আরেকটা কথা কি বলতে পারবেন? এখানে নাকি কুত্তাও হারিয়ে যাচ্ছে। বনের মধ্যে কোনটাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন?
না, দেখিনি, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আরিগন। কুত্তা হারাচ্ছে, সেটা কুত্তা চোরের কাজ হতে পারে। এদিকে কুকুর বিক্রির একটা চোরাই মার্কেট আছে। ওখান থেকে কারা কেনে জানো, ডাক্তারের দালালেরা। কিছু কিছু ডাক্তার কুকুরকে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষণা করে, বড়ই নির-অবলা জানোয়ারের ওপর এই অত্যাচার, ধরতে পারলে মজা দেখাতাম–
কাল একটা লোককে দেখলাম, আমাদের ওপর নজর রাখছে। এক্কেবারে বুনো মনেহলো। পিছু নিয়েছিলাম, ধরতে পারুলাম না, পালাল।
হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমি সাহায্য করতে পারি, একটা আঙুল তুললেন আরিনি। ওর নাম পিচার। বোবা। আর লোক কোথায় দেখলে, বয়েস তো বেশি না। পাশের উপত্যকায় থাকে ওর বিধবা মায়ের সঙ্গে। জন্ম থেকে বোবা নয় সে, কানে শোনে, একটা দুর্ঘটনায় কণ্ঠনালীতে ব্যথা পেয়ে বাকশক্তি হারিয়েছে। সারাটা গরমকাল বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। বুনো ফলমূল আর আশপাশের খামার থেকে চেয়েচিন্তে যা জোগাড় করতে পারে, খায়।
বিপজ্জনক? প্রশ্ন করল মুসা, মানে, ওর কাছ থেকে বিপদের ভয় আছে?
আমি ওকে এড়িয়েই চলি। কিছু হলেই পাথর ছুঁড়ে মারে, হাতের নিশান বড় সাংঘাতিক, বন্দুকের গুলিকেও হার মানায়। কুর্তগুলোকে সে-ও নিয়ে যেতে পারে। জন্তু-জানোয়ার, পাখি, এসবে ওর ভীষণ আগ্রহ।
আশ্চর্য জায়গায় মানুষ এখানে বুনো হয়ে ঘুরে বেড়ায়, রাতে ডাইনী এসে চিৎকার শুরু করে অবাক কাণ্ড না?
চোখের তারায় হাসি ফুটল আরিগনের। ডাইনী-ফাইনী আমি বিশ্বাস করি না। তবে রাতে চিৎকারটা ঠিকই শুনি। লোম খাড়া করে দেয়।
রান্নাঘরে পুটপুট শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠলেন আক্লিান, আমার কফির পানি পড়ে যাচ্ছে! এসো না তোমরা, রান্নাঘরেই চলে এসো।