শোনার অবস্থা নেই মুসার। কোণের দিকে হাত তুলে বলল, চলো তো ওগুলো দেখি?
এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ছয়টা নাদুসনুদুস বাচ্চা ঘুরঘুর করছে তার পায়ের কাছে।
বাহ, বিগলস, চওড়া কাঁধ, সেই তুলনায় খাটো পা আর চোখা লেজওয়ালা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে উঠল মুসা। হঠাৎ একটা বাচ্চা লাফাতে লাফাতে ছুটে এল তার কাছে। তার পায়ে গা ঘষতে লাগল। নিচু হয়ে হাত বাড়াতেই মা জিভ বের করে তার হাত চেটে দিল।
বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে হাসিমুখে বলল সে, এটাই নেব।
ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কত?
দশ ডলার।
নিলাম। মাব্যিাগ বের করুল কিশোর।
আবার তার বাহুতে হাত রাখল রবিন। তাকানোর ইঙ্গিত করল। ভেড়ার খাঁচার সামনে দেখা গেল সেই লোকটাকে, কর্নেল হুমবা। একটা ভেড়া দামদরকরছে।
তোমাদের সঙ্গে এসেছে? ছেলেটা জিজ্ঞেস করল।
না, জবাব দিল রবিন। তবে চিনি।
ওটা নিলে ঠকবে। এত বুড়োর বুড়ো, দাঁড়াতেই পারে না। এই পশু দিয়ে কি করবে?
আমিও তো সে-কথাই ভাবছি, বিড়বিড় করল কিশোর। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল, ভেড়া কিনতে এল কেন হুমবা? পুমাকে খাওয়াবে?
গাড়িতে উঠল ওরা। থরথর করে কাঁপছে কুকুরের বাচ্চাটা। রবিনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, সেরে যাবে। এই প্রথম ভাইবোনদের কাছ থেকে সরে এল তো, ভয় পাচ্ছে। কোলে নিয়ে ওটাকে আদর করল সে।
গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল এবার রবিন। কিশোর, কেবিনে ফিরে যাব?
হ্যাঁ।
গাড়ি চালাল রবিন। কাঁচা এবড়োখেবড়ো রাস্তাটা ধরে কয়েক মাইল এগোনোর পর খেয়াল করল ব্যাপারটা, আরি, গাধা নাকি! এই রাস্তা দিয়ে চলেছি কেন? ব্রিজ না ভাঙা?
অন্যমনস্ক হয়ে ছিল কিশোর। চমকে গিয়ে বলল, তাই তো! আমিও খেয়াল করিনি!
আর মুসা তত কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়েই ব্যস্ত, রাস্তার দিকে তাকায়নি সে।
কয়েক মিনিট ধরে ম্যাপ দেখল কিশোর। বলল, আবার ফিরে যেতে হবে। যেখানে নিলাম হচ্ছে সেখান থেকে আরেকটা রাস্তা গেছে ব্ল্যাক হোলোর দিকে। চলো।
দূর, গাধার মত কাজ করলাম!
নতুন রাস্তাটা আগেরটার মত অত খারাপ না। প্রায় সাতটা বাজে। এখনও সূর্য আছে, কিন্তু বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বেশ আরাম। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়। বেশ কিছু গাড়ি কেবল একটা দিকেই চলেছে।
যাচ্ছে কোথায় ওরা? কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল রবিন। প্রতিটি গাড়িতেই তো মনে হচ্ছে ফুল ফ্যামিলি। সেজেগুঁজে বেরিয়েছে।
মোড় নিতেই কিশোর বলল, ওই যে তোমার জবাব।
বাতাসে ভেসে এল মিউজিক। আরও এগোতে চোখে পড়ল সারি সারি তাঁবু। হ্যারিজ কার্নিভাল নতুন জায়গায় খেলা দেখাতে এসেছে।
ভাল, খুশি হয়ে বলল মুসা, থামব এখানে। আবার পপকর্ন আর পানাট খেতে ইচ্ছে করছে।
থামো!
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, তোমারও ওসব খেতে ইচ্ছে করছে!
না। পুমার খেলা আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
রবিন বুঝে গেল, খেলা দেখাটা আসল ব্যাপার নয়, অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে কিশোরের। কিছু জিজ্ঞেস করল না। গাড়ি রাখল পার্কিঙের জায়গায়। তিনজনে নেমে এগোল পুমার তাঁবুর দিকে। দলে এখন আরও একজন আছে, মুসার বাহুতে গুটিসুটি হয়ে থাকা কুকুরের বাচ্চাটা।
যাচ্ছি তো, বলল মুসা, কিন্তু খেলা দেখাবে কে? হুমবাকে তো দেখে এলাম নিলামের জায়গায়।
এতক্ষণে নিশ্চয় চলে এসেছে, রবিন বলল। উল্টো দিকে গিয়ে সময় নষ্ট করলাম না আমরা।
চলে তো এসেছেই, তিন গোয়েন্দা যখন তাঁবুতে ঢুকল, দেখল খেলাও আরম্ভ হয়ে গেছে। আগের বারের মতই টাইট পোশাক পরেছে হুমবা। সাদা খেলা দেখানোর পোশাকে কিছুটা অন্য রকম লাগছে তাকে, একটু আগে নিলামের জায়গায় যাকে দেখে এল ওরা, তার চেয়ে যেন সামান্য আলাদা। কঠিন শাসনে রেখেছে ভয়ঙ্কর জানোয়ারগুলোকে। তেমনি ঘৃণা দেখা যাচ্ছে ওগুলোর চোখে।
খেলা শেষ হলে, দর্শকরা যখন বেরোনোর গেটের দিকে হুড়াহুড়ি করে এগোল, কিশোর তখন দুই সঙ্গীকে নিয়ে চলল পুমাগুলোকে কাছে থেকে দেখতে। অল্পবয়েসী জানোয়ার, তেল চকচকে শরীর, খাওয়ার কষ্ট পায় না। বোঝা গেল।
আরেকটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে খাঁচার কাছে দাঁড়াল কর্নেল হুমবা।
দারুণ জানোয়ার পোষেণ, হেসে খাতির করার ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কী খেতে দেন?
কাঁচা মাংস, কসাইয়ের দোকান থেকে আনা। শান্তকণ্ঠেই জবাব দিল কর্নেল, তবে কিছুটা অন্যমনস্ক, তাড়াহুড়ো করে সরে গেল ওখান থেকে।
কিন্তু তাকে আমরা ভেড়া কিনতে দেখেছি! ব্ল্যাক হোলোর দিকে আবার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল রবিন। পুমাকে খাওয়াতে যদি কিনে থাকে, বলল না কেন?
কেবিনে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। সূর্য ডুবে গেছে, বনের মধ্যে অন্ধকার, কিন্তু আকাশ এখনও পুরোপুরি কালো হয়নি, কেমন একধরনের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে।
ছেলেরা আশা করল, এইবার কেবিনে ঢুকে গৃহকর্তাকে দেখতে পাবে। কিন্তু নীরব হয়ে রইল বাড়িটা। কেউ বেরিয়ে এল না ওদের স্বাগত জানাতে। ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর তার নোটটা পড়ে থাকতে দেখল কিশোর। ফেরেননি ক্যাপ্টেন রিচটন।
হলো কি তার? উদ্বেগে ফেটে পড়ল রবিন, খুঁজে বের করতেই হবে, যত জলদি পারা যায়!
হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, শোনো, গাড়ি!
ক্যাপ্টেন এসেছেন মনে করে দরজার কাছে দৌড়ে এল ছেলেরা। খোলা জায়গায় ঢুকেছে গাড়িটা, সব আলো নেভানো, কেবল পার্কিং লাইট জ্বলছে। মোটাসোটা, খাটো একজন মানুষ নামল। পরনে বিজনেস স্যুট। দড়াম করে। দরজা লাগিয়ে গটমট করে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে।