চুলের কাঁটার মত অনেকগুলো তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার পর আরেকটা বাকের কাছে এসে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল:
গতি কমান!
সামনে পুল
ভারি গাড়ি নিষিদ্ধ।
মোড় পেরোলে কাঠের ব্রিজটা চোখে পড়ল। দু-পাশে লোহার রেলিঙ আছে বটে, তবে এতই হালকা, কোন গাড়ির পতন রোধ করতে পারবে না ওগুলো। নিচে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদীর স্রোত।
বোকামি করে বসল মুসা। ভাবল, পেরিয়ে যেতে পারবে, কিশোর বাধা দেয়ার আগেই গাড়ি তুলে দিল ব্রিজে। অর্ধেক যেতে না যেতেই মড়মড় করে উঠল নিচের তক্তা, গাড়িটার ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়ছে।
চিৎকার করে উঠল কিশোর, থেমো না, থেমো না, চালিয়ে যাও!
.
০৬.
চমকে গিয়ে ব্রেক চেপে ফেলছিল মুসা, কিশোরের চিৎকারে সেটা ছেড়ে দিয়ে আরও জোরে চেপে ধরল অ্যাক্সিলারেটর। লাফ দিয়ে এগোতে গেল ভারি গাড়িটা। পারল না, পেছনের অংশ বসে যাচ্ছে।
পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে! বলে পেছনের সীটে বসা রবিন চেঁচাতে শুরু করল।
অ্যাক্সিলারেটর ছাড়ল না মুসা। ভীষণ গোঁ গো শুরু করল ইঞ্জিন। পড়ে যাবেই, আর বাঁচানো গেল না!–যখন ভাবছে সে, এই সময় সামনের কাঠে কামড় বসাল টায়ার। টেনে তুলল গাড়ির পেছনের অংশটাকে। নিরাপদে টেনে আনল ব্রিজের অন্যপ্রান্তে, রাস্তার ওপর।
কখন যে অ্যাক্সিলারেটর ছেড়ে দিল মুসা, বলতে পারবে না। ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। কেয়ার করল না সে। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, বেঁচেছি, উফ! থরথর করে কাঁপছে সে।
কাঁপছে অন্য দুজনও।
ব্রিজের কতটা ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে নেমে এল তিনজনে। মাঝখানের দুটো তক্তা ঝুলে আছে নিচের কালো পানির দিকে, আরেকটা গায়েব।
কোন গাড়ি উঠলেই এখন মরবে, গম্ভীর স্বরে কিশোর বলল। সাবধান করার ব্যবস্থা করা দরকার।
কি করে করব? রবিনের প্রশ্ন।
লোহার কাঠামোতে পা রেখে আর রেলিঙ ধরে প্রায় ঝুলে ঝুলে আবার। অন্যপাশে চলে এল ওরা। পাহাড় থেকে শুকনো ডাল এনে পথের ওপর বিছিয়ে, তার সামনে বড় বড় পাথর রেখে দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করল। এপাশটাতেও একই ভাবে প্রতিবন্ধক তৈরি করে দিল।
আবার গাড়িতে ওঠার পর রবিন বলল, একটা ফোন পেলেই রিপোর্ট করতে হবে।
বনে ঢাকা পাহাড়ের ঢালের নিচ দিয়ে প্রায় মাইলখানেক এগোনোর পর পথের ধারে একটা খামারবাড়ি চোখে পড়ল। নেমে গেল তিন গোয়েন্দা। লেটার বক্সে নাম লেখা: হুফার কট। দরজা খুলে দিলেন বাড়ির মালিক, সবে। খেতে বসেছিলেন, ঘণ্টা শুনে উঠে এসেছেন। খবরটা শুনে ফোনের দিকে। দৌড় দিলেন তিনি।
মিসেস কট বললেন, ওখানে বহুবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, পথের মোড়টার জন্যেই এমন হয়। একবার একটা গাড়ি স্পীড না কমিয়েই উঠে পড়েছিল ব্রিজে, আর সামলাতে পারেনি, রেলিং ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, একজনও বাঁচেনি। তোমাদের ভাগ্য খুব ভাল, বেঁচে এসেছ?…এসো না, বসে যাও আমাদের সঙ্গে, খাও।
খুব ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করল কিশোর। বলল, ওরা খেয়ে এসেছে, তা : ছাড়া পাশের শহরে নিলাম দেখতে যাচ্ছে। দেরি করলে গিয়ে আর পাবে না।
কটদেরকে গুডবাই জানিয়ে ফিরে এসে গাড়িতে উঠল ওরা।
পনেরো মিনিট পর সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। তীর চিহ্ন এঁকে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কোন দিকে যেতে হবে। বড় বড় অক্ষরে লেখা:
পশু নিলাম
একশো গজ সামনে।
বেশ কয়েকটা লাল রঙ করা বাড়ি আর খোয়াড়ের সামনে পার্কিঙের জায়গা। ওখানে গাড়ি রাখল মুসা। তিনজনেই নেমে এগোল উঁচু ছাতওয়ালা একটা বাড়িতে। সারি সারি বে রাখা। অনেক লোক বসে আছে ওগুলোতে। সামনের কাঠের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েস্টকোট পরা একজন। রোগা টিংটিঙে লোক, শরীরের তুলনায় অস্বাভাবিক ভারি কণ্ঠে একটা বাদামী সাদা বাছুরের গুণগান করছে। বাছুরটাকে ধরে রেখেছে তার সহকারী।
এটা বড় জানোয়ারের জায়গা, কিশোর বলল। কুকুর অন্য কোন ঘরে।
আবার বেরোনোর দরজার দিকে এগোল তিন গোয়েন্দা। হঠাৎ কিশোরের হাত খামচে ধরল রবিন। একটা বেঞ্চে চাষীদের মাঝখানে বসে আছে লম্বা এক লোক। সতর্ক, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, পুরু গোফ। চওড়া কানাওয়ালা একটা হ্যাট মাথায়। গায়ে সুন্দর ছাঁটের স্পোর্টস জ্যাকেট।
চিনতে পারো? জিজ্ঞেস করল রবিন।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল মুসা ও কিশোর। চেনাই লাগছে।
হঠাৎ লম্বা মানুষটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরে গেল ওদের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল তিনজনেই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে এল।
কর্নেল হুমবার মত লাগল না? রবিন বলল। এখানে কি করছে?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
লম্বা, সরু একটা ঘরের ভেতর থেকে বিচিত্র কোলাহল আসছে। মুসা বলল, কুকুর ওটাতে।
ঢুকল ওরা! মুরগি, কুকুর, শুয়োর, ভেড়া, ছাগল, খরগোশের খাঁচায় বোঝাই এ ঘরটা। ঘরের শেষ মাথায় রয়েছে কুকুরের খাঁচা। বেশির ভাগ কুকুরই দেখা গেল শ্রমিক কিংবা শিকারী জাতের। পশু খেদানোর কোলি কুকুরগুলোর পাশ কাটিয়ে এল মুসা, এগোল লম্বা কান, কোমল, আকর্ষণীয় চোখওয়ালা হাউন্ডগুলোর দিকে।
হাউডই আমার পছন্দ, বলল সে। পছন্দ করতে শুরু করল, কোনটা নেব? কুন হাউন্ড? উই, বেশি বড়। ব্লাড হাউন্ড? বেশি গোমড়া। ব্যাসিট? মোটুকরাম, পা এত খাটো, মনে হয় জন্মদোষ।
সবারই তো এ দোষ না সে দোষ, মুচকি হেসে বলল রবিন। তাহলে নেবেটা কি?