.
০৫.
কারও সঙ্গে একঘরে থাকতে আমি পারব না, ঘোষণা করে দিলেন রাবাত, নিজের নাতি হলেও না! পোলাপানকে বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসবে ঠিক নেই। হয়তো দেখা যাবে রাত দুপুরে উঠে পনির দিয়ে রুটি খেতে বসল। হই-চই করে, শব্দ করে আমার ঘুমের বারোটা বাজাবে।
অতএব ঘুমের সুবিধার জন্যে মনটিরের ফিশারম্যান ওআর্য থেকে কয়েক ব্লক দূরে একটা মোটেলে দুটো কামরা ভাড়া করলেন তিনি। তারপর ক্যানারি রো-র একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন ছেলেদের। চমৎকার রান্না করা নানা রকম মাছের স্বাদ বহুদিন মনে থাকবে তিন গোয়েন্দার। খেতে খেতে মনটিরে আর স্প্যানিশ ক্যালিফোর্নিয়ার অনেক ইতিহাস বললেন। মেজাজ একেবারে ফুরফুরে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মিলারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা যেন বহুযুগ আগের ব্যাপার। কোনই গুরুত্ব নেই ওটার। মন থেকে দূর করে দিয়েছেন বেমালুম।
সে-রাতে সকাল সকাল ঘুমাতে গেল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল তিন গোয়েন্দা, আলাদা ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করে একটা কাজের কাজ করেছেন রাবাত। তাতে তার চেয়ে ওদের উপকার হয়েছে বেশি। একঘরে থাকলে সারারাত জেগে থাকতে হত। এত জোরে নাক ডাকাচ্ছেন, দুটো ঘরই কাঁপতে শুরু করল।
সাইনাসের সমস্যা আছে, অনুমান করল রবিন।
মা বলে ওসব কিছু না, মুসা বলল, রোগটোগ নেই। আসলে ঘুমের মধ্যেও নানা চান না তাকে অগ্রাহ্য করা হোক।
মাঝখানে একটা দেয়াল থাকলে সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যেত তিন গোয়েন্দা। অন্য ঘর থেকে আসছে বলে রক্ষা। তা-ও যা শব্দ! তবে একবার ঘুমিয়ে পড়ার পর আর অসুবিধে হলো না, একটানা ঘুমাল সকাল পর্যন্ত।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকল সকালের রোদ। ঘুম ভাঙল ওদের। শুনতে পেল, উঠে পড়েছেন রাবাত। বাথরুমে তার শাওয়ারের শব্দ। পাওয়া যাচ্ছে। ওরাও উঠে পড়ল। হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরে তৈরি হলো। দরজায় খটখটানির শব্দ। রাবাত ডাকছেন।
জেটির ধারে একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতে বসল ওরা। ভাজা মাংস, কেক আর এক জগ কমলার রসের অর্ডার দিলেন রাবাত। ঘুম ভাল হওয়ায় শরীরটা ঝরঝরে লাগছে কিশোরের। খাবারে আনন্দ পাচ্ছে তাই। খেতে খেতে সাগর দেখার জন্যে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে একজন লোক। তাড়াতাড়ি আবার প্লেটের দিকে নজর ফেরাল, যাতে তার চমকে যাওয়া রাবাতের চোখে না পড়ে। কেকের একটা টুকরো ভেঙে সিরাপে চুবিয়ে মুখে পুরল।
নানার পাশে, কিশোরের মুখোমুখি বসেছে মুসা। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না তার। প্রশ্ন করার জন্যে মুখ খুলেও থেমে গেল। ভ্রুকুটি করে আর সামান্য মাথা নেড়ে তাকে চুপ থাকতে ইশারা করেছে কিশোর।
তার দিকে তাকিয়ে রাবাত জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু খাবে তোমরা?
মাথা নাড়ল কিশোর, না, অনেক হয়েছে। পেট ভরে গেছে।
খুব ভাল খাবার, রবিন বলল।
চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। খাবারের দাম দেয়ার জন্যে ক্যাশিয়ারের ডেস্কের দিকে এগোলেন।
সামনে গলা বাড়িয়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা, কি দেখেছিলে, কিশোর?
হ্যারিস মিলারকে, ক্যানারি রো-র দিকে যাচ্ছে।
ফিরে এলেন রাবাত। ওয়েইটারের জন্যে প্লেটে টিপস রেখে দিয়ে ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, পানির কিনারটা ঘুরে দেখতে চাও? বেশি দেরি করা যাবে না। আজ রাতেই স্যান ফ্রান্সিসকো পেরোতে চাই। সম্ভব হলে সান্তা রোজাতে চলে যাব। কালকের দিনটা তাহলে রেডউডের বনে ঘুরে। কাটাতে পারব।
তার পেছন পেছন রেস্টুরেন্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এল ছেলেরা। রবিনের কাঁধে ঝোলানো একটা আনকোরা নতুন ক্যামেরা। রকি বীচে কেনার পর একটা ছবিও তোলা হয়নি ওটা দিয়ে। এখান থেকে শুরু করার ইচ্ছে তার।
সবাইকে নিয়ে জেটির কাছে চলে এলেন রাবাত। ঘাটে বাঁধা ছোট-বড় অনেক নৌকা ঢেউয়ে দুলছে। জাহাজ বেরিয়ে যাচ্ছে খোলা সাগরে।
এখনও খুব সকাল, কিন্তু জেটিতে পুরোপুরি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। রাতে ধরে আনা মাছ নামাচ্ছে জেলেরা। দোকানে দোকানে টুরিস্টদের ভিড়। বিশেষ করে ঝিনুক-সামগ্রীর দোকানগুলোতে। খটাখট ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগল রবিন। মুসার চোখ আকাশে চক্কর দেয়া সী-গালের খেলা। দেখছে। অলস ভঙ্গিতে রাবাত তাকিয়ে আছেন একটা দোকানের দিকে।
ধীরে ধীরে নজর সরে গেল রাস্তার দিকে। মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি। শক্ত হয়ে গেল কাধ।
কি বলেছিলাম! শয়তানটা এখানেও এসেছে!
না তাকিয়েও বলে দিতে পারবে কিশোর কার কথা বলছেন রাবাত। হ্যারিস মিলার ছাড়া আর কেউ না। আবার এসেছে যেন রাবাতের হাসিখুশি মেজাজটাকে পলকে বিগড়ে দেয়ার জন্যে। আগুন বানিয়ে দেয়ার জন্যে।
নানা, তাড়াতাড়ি দুহাত তুলে এগিয়ে এল মুসা, দোহাই তোমার, চুপ করে থাকো! কিছু বোলো না!
ভয়ানক ভঙ্গিতে নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন রাবাত। বেশ! তবে এখানে আমি আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়াব না!
ঝিনুকের দোকানটায় ঢুকে পড়লেন তিনি। বিশাল এক দানবীয় ঝিনুকের খোলার ওপাশে মুখ লুকিয়ে ফেললেন। জানালার কাচের ভেতর দিয়ে গোয়েন্দারা শুধু তার কোকড়া চুলগুলো দেখতে পেল।
ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল মিলার। তার ওপর যে নজর রাখা হচ্ছে, বুঝতে পারেনি। কাঁধে ঝোলানো নতুন ক্যামেরার ব্যাগ, ক্যামেরাটা হাতে। অবিকল রবিনেরটার মত, একটা Canon II. রবিনের মতই জেটির দৃশ্যের ছবি তোলায় আগ্রহী মনে হলো তাকে। তবে তুলছে না। সকালের ট্যুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেছে। সবই নতুন তার। গায়ের সাদা শার্টটা নতুন–গলার কাছে দুটো বোতাম খোলা, পরনে নতুন জিনসের প্যান্ট। পায়ে রবার সোলের নতুন জুতো। রকি বীচ থেকে বেরোনোর পর পথে কোনখান থেকে একটা নতুন স্ট্র হ্যাটও কিনেছে। হ্যাঁটের চওড়া কানা ছায়া ফেলেছে মুখে।