নানা! গলা চড়িয়ে ডাকল আবার রবিন।
নানা, কোথায় তুমি? আরও জোরে ডাকল মুসা। জবাব দিচ্ছ না কেন?
চুপ! এতক্ষণে শোনা গেল একটা ভোতা, খসখসে কণ্ঠ।
এক ঝলক বাতাস আচমকা ফাঁকা করে দিল কুয়াশার খানিকটা। রাবাতকে চোখে পড়ল গোয়েন্দাদের। পাহাড়ের গোড়ায় বড় একটা পাথরের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছেন। সতর্ক, উত্তেজিত, কোন কিছুর দিকে নজর। রাখছেন মনে হচ্ছে।
নানা, কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মুসা।
তাকে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করলেন রাবাত। খানিক পর রাগত স্বরে বলে উঠলেন, যা সন্দেহ করেছিলাম!
নিঃসঙ্গ সেই লোকটাকে দেখা গেল আবার, যে কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেক কাছে চলে এসেছে। ছায়ার মত দেখা যাচ্ছে এখন। সাবধানে পা ফেলছে। যেন কুয়াশার জন্যে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত। ঝাঁপিয়ে পড়লেন লোকটার ওপর।
চিৎকার করে উঠল লোকটা।
লোকটার কলার চেপে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন রাবাত, এত্তবড় সাহস তোমার, আমার পিছু নিয়েছ!
ছাড়ো, পাগল কোথাকার! নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল লোকটা।
খাইছে! দম আটকে যাবে যেন মুসার।
রাবাত, তুমি একটা উন্মাদ! বলল লোকটা। পুরোপুরি মাথা খারাপ! জলদি ছাড়ো বলছি, নইলে ভাল হবে না!
কণ্ঠ শুনেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে মুসা। হ্যারিস মিলার। তার নানার পড়শী, যার সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক।
হুমকির পরোয়া করলেন না রাবাত। কলার তো ছাড়লেনই না, আরও জোরে চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। চোর কোথাকার! আমি জানি তুমি কিসের জন্যে এসেছ! রাতে চুরি করে আমার ঘরে ঢুকেছিলে, নতুন আবিষ্কারটার কথা জেনে গেছ। যন্ত্রপাতি চুরি করেই পেট ভরেনি, ফর্মুলাও চুরি করতে এসেছ…।
ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মিলার। পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার শুরু করল, বাঁচাও! বাঁচাও! পুলিশ! পাগলে খুন করে ফেলল আমাকে!
লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল মুসা। মিলারের হাত আঁকড়ে ধরে বলল, চেঁচাবেন না, মিস্টার মিলার, প্লীজ! নানা এমনি কথার কথা বলেছে, সত্যি সত্যি খুন করতে চায়নি আপনাকে…
চুপ! গর্জে উঠলেন রাবাত। স এখান থেকে! আমার জন্যে মাপ চাইতে হবে না! যা বলেছি ঠিকই বলেছি, মোটেও কথার কথা নয়! মেরুদণ্ডহীন এই পোকাটা কি করতে চাইছে আমি জানি। কিছুতেই সেটা করতে দেব না ওকে। ল্যাঙ মেরে ফেলে ওর কোমর ভেঙে না দিয়েছি তো। আমার নাম…
আবার মিলারকে ধরার চেষ্টা করলেন রাবাত।
ঝট করে সরে গেল মিলার। আর চিৎকার করল না। সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবাতের দিকে।
ইঁদুর! ছুঁচো! শুয়াপোকা! গাল দিতে লাগলেন রাবাত। এই জন্যেই, এতক্ষণে বুঝলাম! এই জন্যেই বিষবার থেকে কাজে যাচ্ছ না তুমি! বাড়িতে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রেখেছ। যেই আমি বেরিয়েছি, আমার পিছু নিয়েছ। কেন নিয়েছ, মনে করেছ বুঝব না! অত বোকা পাওনি!
পাগলের সঙ্গে কে কথা বলে! বলেই ঘুরে সৈকত ধরে প্রায় ছুটতে শুরু করল মিলার।
সত্যি কথা বলেছি তো, সহ্য করতে পারলে না, তাই না! পেছনে চিৎকার করে বললেন রাবাত।
ফিরল না মিলার। জবাবও দিল না। খেপা মানুষটার কবল থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে। আবার অদৃশ্য হয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
অসহ্য! নাক দিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করতে লাগলেন রাবাত। জঘন্য লোক! আবার যদি আসে, বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দেব আমি ওর!
এতক্ষণে খেয়াল করল মুসা, কাঁপছে ও। একটা দুঃস্বপ্ন থেকে যেন জেগে উঠেছে। এ কার সঙ্গে এসেছে! মারাত্মক অবস্থা! স্যান ফ্রান্সিসকোতে পৌঁছার আগেই হয়তো ভয়ানক বিপদে ফেলে দেবে। উপকূলের কোন জেলখানায় হবে শেষ ঠাই। এমনও হতে পারে, নানার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে। তাকে সামলানো অসম্ভব ভেবে রকি বীচে ফিরে যেতে পারে কিশোর আর রবিন। নিউ ইয়র্ক যাওয়া আর হবে না।
নানা, বলল সে, আমার মনে হয় অহেতুক মিস্টার মিলারকে গালাগাল করছ। পিজমো বীচটা বেড়ানোর জায়গা, যে কেউ আসতে পারে এখানে। মিলারের আসতেও বাধা নেই। এমনও হতে পারে, এখানে কোন বন্ধু আছে তার, দেখা করতে এসেছে।
তোর মাথা! খেঁকিয়ে উঠলেন রাবাত। ওর আবার বন্ধু আছে নাকি! দুনিয়ায় কেউ ওর বন্ধু হবে না! শুনে রাখ, তার সঙ্গে এই শেষ দেখা নয় আমাদের। না হলে তখন বলিস। কিন্তু যেটার জন্যে এসেছে সেটা পাবে না সে। অত কাঁচা কাজ করি না আমি। ওর মত ছুঁচোরা যে পিছে লাগতে পারে, সেটা আগেই ভেবে রেখেছি।
কি নিতে এসেছে? এমন নিরীহ ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল কিশোর, যেন কথার পিঠে কথা, জানার কৌতূহল নেই।
আমার ফর্মুলা! জবাব দিলেন রাবাত।
যেটা আবিষ্কার করেছ? মুসার প্রশ্ন। যেটা নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাচ্ছ?
তোরাও এমন ভঙ্গি করছিস যেন আমি একটা পাগল! আবিষ্কার যেটা করেছি, জানলে নিউ ইয়র্কের বড় বড় বিজ্ঞানীরাও…
থেমে গেলেন তিনি। ফাস করে দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খেয়াল হলো যেন। না, তোদের না জানাই ভাল। হয়তো মিলার একাই চায় না ওটা, আরও কেউ আছে। চল। আর দেরি করলে অন্ধকার হওয়ার আগে মনটিরেতে পৌঁছতে পারব না।
শান্ত ভঙ্গিতে বালি মাড়িয়ে হেঁটে চললেন তিনি। কয়েক মিনিট আগে যে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল বেমালুম ভুলে গেছেন যেন।
পেছনে এগোল তিন গোয়েন্দা। মনে ভাবনা। দীর্ঘ যাত্রায় বেরিয়েছে ওরা। শেষ হতে এক মাস কিংবা তারও বেশি লেগে যেতে পারে। এ রকম একজন মানুষের সঙ্গে টিকতে পারবে অতদিন? শুধু কি খামখেয়ালী, না। আসলেই পাগল? একজন বদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে অজানা পথে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে না তো ওরা!