খুব সুন্দর! রাবাত বললেন। যতই এগোব, আবহাওয়া আরও ভাল। হবে।
যতই উত্তরে এগোল ওরা, শুধু আবহাওয়া নয়, প্রকৃতিরও রূপ বদল হতে থাকল। কখনও সাগরের কিনার দিয়ে গেছে পথ, তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একেবারে ধার ঘেষে; কখনও পাহাড়ের চূড়ার কাছ দিয়ে, ওখান থেকেও সাগর চোখে পড়ে। গ্যাভিয়োটা ছাড়িয়ে কয়েক মাইল এসে পাওয়া গেল একটা সুড়ঙ্গ, রাস্তা গেছে তার ভেতর দিয়ে। সুড়ঙ্গের অন্য পাশে বদলে গেল। প্রকৃতি। সাগরের ঢেউয়ের বদলে এখানে দেখা গেল গরু-বাছুরের পাল। শীতের বর্ষণের শেষে মাঠের ঘাস এখন সবুজ। ছড়ানো সর্ষে খেতে সবুজের মাঝে বিছিয়ে থাকা হলুদ ফুলকে লাগছে বিশাল হলুদ চাদরের মত। ঢালের গায়ে তৃণভূমিতে চরছে গরু-ঘোড়া, মহা আনন্দে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে বাছুর আর ঘোড়ার বাচ্চা।
দুপুরের পর, বিকেলের শুরুতে আবার সাগরের দেখা পাওয়া গেল।
ওই যে পিজমো বীচ! রাবাত বললেন। মুসা, তোর মা তখনও হয়নি, তোর নানীকে নিয়ে বেড়াতে আসতাম এখানে। সাগরের পাড়ে ঝিনুক খুঁজে বেড়াতাম। বহু বছর আগের কথা, অথচ মনে হচ্ছে এই সেদিন! এখন তোর নানী নেই, আছে শুধু ঝিনুক! একা একা কুড়াতে আর ভাল লাগে না রে, তবে সৈকতের পানিতে গাড়ি চালাতে এখনও মজা পাই।
পানিতে! বিশ্বাস করতে পারল না রবিন। পারবেন? চাকা আটকে যাবে না?
না, পিজমোতে যাবে না। কোন্ জায়গাটাতে নামতাম আমরা, দেখি বের করতে পারি কিনা?
হাইওয়ে থেকে একটা সরু রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনলেন রাবাত। সাগরের দিকে নামতে নামতে পথের শেষ মাথায় চলে এলেন। তারপরে রয়েছে একটা র্যাম্প। সেটার পর সৈকত।
বালির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, সত্যি বলছ, নানা, কাদায় চাকা দেবে যাবে না? চোরাবালি যদি থাকে?
দূর বোকা, এ সব জায়গায় থাকে না। ওই দেখ, আরেকটা গাড়ি নেমেছে।
একেবারে পানি ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছে একটা ফোক্সওয়াগেন। তীরে আছড়ে ভাঙছে ঢেউ। কোন কোনটা এতবড়, গাড়ির চাকা আর নিচেটা ভিজিয়ে দিয়ে। এ পাশে চলে আসছে।
খাইছে! বলে উঠল মুসা, ফোক্সওয়াগন বলেই চলছে এখনও। বুইক পারবে না, ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যাবে।
থাম তো! অধৈর্য হয়ে নানা বললেন, দেখই না কি করি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। অন্য কেউ এখানে গাড়ি চালালে ভয়। পেত না। কিন্তু তার নানাকে বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। এত ঘনিষ্ঠভাবে কোনদিন মেশার সুযোগ পায়নি। বদমেজাজী বলে এড়িয়েই থেকেছে। নানার হাতে নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।
র্যাম্প পার হয়ে এসে বালিতে নেমে পড়ল বুইক। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল সৈকত ধরে। তীর থেকে খানিকটা দূরে পানির ওপরে কুয়াশা জমছে। রাবাত বললেন, এই এক যন্ত্রণা! খালি কুয়াশা পড়ে এখানে। ভৌগোলিক কারণ একটা নিশ্চয় আছে। কিন্তু কি, কে জানে!
গাড়ি থামিয়ে, হ্যান্ডকে সেট করে দিয়ে ফিরে তাকালেন তিনি। আমি এখানে নামব। পা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তোরা?
নামব, একটানে পাশের দরজা খুলে ফেলল মুসা।
চোখের পলকে খুলে গেল চারটে দরজাই। গাড়ি থেকে প্রায় ছিটকে বেরোল চারজনে। দরজায় তালা লাগালেন রাবাত। তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে সৈকত ধরে হেঁটে চললেন।
কয়েক মিনিটেই পিজমা বীচের শহর ছাড়িয়ে এল ওরা। লম্বা একটা দেয়াল ঘেঁষে প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো কয়েকটা বাড়ি-ঘর, এই হলো শহর। পাহাড়ের চূড়া আর ঢালে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল ও মোটেলগুলো।
কাছে এসে গেছে কুয়াশা। ধীরে ধীরে যেন জড়িয়ে ধরতে আরম্ভ করেছে ওদের। চোখের আড়াল করে দিয়েছে একপাশের সৈকত। কেমন ভূতুড়ে নীরবতা গ্রাস করছে সমস্ত পরিবেশকে। চুড়ার ওই হোটেলগুলোর ওপাশে রয়েছে হাইওয়ে। কাছেই। অথচ একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও কানে আসছে না।
সামনে বিছিয়ে আছে প্রায় নির্জন সৈকত। একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। ঘন হয়ে গেল কুয়াশা। তার মধ্যে হারিয়ে গেল। লোকটা। ওদের চারপাশে এখন শীতল, শূন্য, ধূসর এক পৃথিবী।
বিচিত্র অনুভূতি হলো কিশোরের। মনে হচ্ছে, ভয়ানক বিপজ্জনক কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মধ্যে। এমন কিছু, যা অক্টোপাসের মত উড় বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলে যাবে অজানা কোন জগতে, চিৎকার করে সাহায্য চাওয়ারও ক্ষমতা হবে না ওদের।
মাথা ঝাড়া দিয়ে ভয় তাড়ানোর চেষ্টা করল সে। মনকে বোঝাল, অহেতুক ভয় পাচ্ছে। কিছুই নেই এখানে। কেবল ঘন কুয়াশা সূর্যকে ঢেকে দিয়ে জায়গাটাকে অন্ধকার, বিষণ্ণ আর অপার্থিব করে তুলেছে।
অনেক দূর চলে এসেছি আমরা, তাই না, নানা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কিশোরের আগে রয়েছে সে। মূসার সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। প্রশ্নটা করে জবাবের আশায় ডানে তাকাল সে। কিন্তু কোথায় রাবাত?
মুসাও থমকে দাঁড়াল। নানা! কোথায় তুমি?
জবাব নেই।
মিস্টার রাবাত! চিৎকার করে ডাকল কিশোর।
কয়েক সেকেন্ড কান পেতে রইল সে। রাবাত গেলেন কোথায়? কুয়াশার মধ্যে জলজ্যান্ত একজন মানুষ অদৃশ্য হতে পারে, গায়েব হয়ে যেতে পারে না!
মুসাও ভয় পেয়েছে। চাপা স্বরে বলল, এই, কাছাকাছি থাকো সবাই। রবিনের কাঁধে হাত রাখল। যেন তাকেও গায়েব হওয়া থেকে ঠেকাতে চায়।