কারও দিকে তাকালেন না আর রাবাত। চুপচাপ কাপের কফি শেষ করলেন। তারপর মুখ তুললেন। মেয়ের দিকে তাকালেন না। কণ্ঠস্বরও নরম। করলেন না। খসখসে গলায় বললেন, আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করব। কারও বাধা মানতে আমার বয়ে গেছে। আমি ঠিক করেছি, ছেলেগুলোকে আমি সঙ্গে নেব। তবে দারোয়ান হিসেবে নয়। এত লম্বা পথ, মুখ বুজে থাকা যাবে না। কথা বলার জন্যেও কাউকে দরকার। তার জন্যে ছোটরাই উপযুক্ত। বুড়োগুলোর নানা ফেঁকড়া, নানা ঝামেলা। তর্ক ছাড়া কিছু বোঝে না, বেশি পেকে যায় তো! আড়চোখে মেয়ে আর জামাইয়ের দিকে তাকালেন তিনি। পেইত্রি কিংবা কক বিলার্ডকে নিতে পারতাম। কিন্তু বেড়াতে বেরোলেই বিশাল এক সুটকেস সঙ্গে নেবে পেইত্রি, তাতে থাকবে। হাজার রকমের ওষুধপত্র। কক হলো বীমার লোক। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে, তবু শুধু বীমা, বীমা। দুনিয়ায় যেন এ ছাড়া আর কোন বিষয়ই নেই। সুতরাং মুসা এবং তার দুই দোস্ত আসতে পারে আমার সঙ্গে। মুসা, স্কুল ছুটি হতে আর কদ্দিন? দুই হপ্তার বেশি না নিশ্চয়? ঠিক আছে, অপেক্ষা করতে পারব আমি। তোদের স্কুল ছুটি হলেই রওনা হব। জুনের শুরুতে যাত্রা করব। আমরা। অতিরিক্ত গরম পড়ার আগেই খোলা অঞ্চল পেরিয়ে যেতে পারব। ফিরে আসব ক্যানাডার ভেতর দিয়ে। ভাবতে কেমন লাগছে রে তোর?
লাফিয়ে উঠল মুসা। আর বোলো না, নানা! দম আটকে আসছে। আমার! স্কুলটা যে কবে ছুটি হবে! সহ্য করতে পারছি না!
রবিন আর কিশোরকে সুখবরটা জানানোর জন্যে ফোনের দিকে প্রায় উড়ে গেল সে।
স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে এরপর দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি চলল। বাড়িতে জরুরী কোন কাজ নেই, তাই মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিতে রবিনের তেমন অসুবিধে হলো না। তবে কিশোরকে নিয়ে ঘাপলা বাধাতে চাইলেন মেরিচাচী। ইয়ার্ডে প্রচুর কাজ। তিনি ভেবেছিলেন, স্কুল ছুটি হলে বাড়তি কাজগুলো কিশোরকে দিয়ে করিয়ে নেবেন।
কিশোর তাকে বোঝাতে চাইল, শোনো, কাজ তো সারাজীবনই করা যাবে, করতে হবে। কিন্তু এ রকম সুযোগ আর আসবে না। তা ছাড়া এ সব ভ্রমণে অভিজ্ঞতা বাড়ে। বুদ্ধি বাড়ে। চিন্তাশীল হতে শেখায় মানুষকে।
তোর কি চিন্তা করার অসুবিধে নাকি? বুদ্ধিও কম না! যা আছে তাতেই একেক সময় ভয় হয়, মাথাটা না বিগড়ে যায়!
চিলেকোঠা থেকে একটা স্লীপিং ব্যাগ বের করে আনলেন মেরিচাচী। রোদে শুকাতে দিলেন।
সেটা দেখে আশা হলো কিশোরের। তারমানে যেতে দিচ্ছ তুমি আমাকে?
জবাব না দিয়ে প্রশ্ন করলেন চাচী, জুন মাসে মিনেসোটার আবহাওয়া কেমন থাকে জানিস?
বিউটিফুল! জবাব দিয়ে দিলেন কাছে দাঁড়ানো রাশেদ পাশা। দাঁতের ফাঁক থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন, চমৎকার!
চাচার সমর্থন পেয়ে চোখ উজ্জ্বল হলো কিশোরের। চাচীকে বলল, তুমি হিসেবগুলোর কথা ভাবছ তো? যাও, বেড়াতে যাওয়ার আগেই সব শেষ করে দেব। আর কোন অসুবিধে আছে?
এতক্ষণে হাসি ফুটল মেরিচাচীর মুখে। কিশোর যখন কথা দিয়েছে, ধরে নেয়া যায় কাজটা হয়ে গেছে। হিসেব মেলানোটা সাংঘাতিক ঝামেলার কাজ মনে হয় তার কাছে।
অবশেষে ছুটি হলো স্কুল।
জুনের এক কুয়াশা ঢাকা সকালে নিজের গাড়িতে করে তিন গোয়েন্দাকে মিস্টার রাবাতের বাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলেন আমান। সুটকেস এনেছে ওরা, তবে স্লীপিং ব্যাগ আনেনি। সাফ মানা করে দিয়েছেন রাবাত, বাইরে ক্যাম্প করে ঘুমানো চলবে না। বলেছেন, বাইরে রাত কাটানোর বয়েস আমার নেই। এটাই হয়তো জীবনের শেষ অ্যাডভেঞ্চার। অতএব কিপটেমি করে দীনহীনের মত দিনগুলো না কাটিয়ে হোটেলে থাকব, মোটেলে থাকব। যতটা সম্ভব আরামে কাটাব।
নানার মত অত বয়েস না হলেও বয়েস হয়েছে তার পুরানো, বিশাল বুইক গাড়িটার। তবে যথেষ্ট সমর্থ এখনও। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে।
রওনা হলো ওরা। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন আমান। শেষবারের মত বাবাকে বিদায় জানানোর জন্যে পেছনে ফিরে হাত নাড়ল মুসা। কিশোরও তাকাল। দুজনেরই চোখে পড়ল, রাবাতের বাড়ির কোণ থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে আসছে গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ। ঝোপের আড়ালে অর্ধেক শরীর আড়াল করে তাকিয়ে দেখছে রাবাত সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন কিনা।
হ্যারিস মিলারকে চিনতে পারল দুই গোয়েন্দা।
খালি পেয়েই ঢুকে পড়েছে। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করেনি। বিড়বিড় করল মুসা। মতলবটা কি?
কিশোর জবাব দেয়ার আগেই সামনের সীট থেকে গাঁক করে উঠলেন নানা, কি বলছিস?
কিছু না, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। ভাবছি, সান্তা বারবারার ওই রেস্তোরাঁটায় থামবে কিনা? ওই যে, যেটাতে ঘরের বাইরে টেবিল, পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
ভাল বলেছিস, খুশি হয়ে উঠলেন রাবাত। নাতির মতই খাওয়ার ব্যাপারে তারও প্রবল আগ্রহ। হয়তো তাঁর কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতাটা পেয়ে গেছে মুসা। আমার তো খিদেয় পেট জ্বলছে। নাস্তা না খেয়ে আর পারব না।
অবাক হলো মুনা নাস্তা না খেয়েই বেরিয়েছ!
মনে নেই!
প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে নতুন উদ্যমে গাড়ি হাঁকালেন রাবাত।
মুচকি হাসল কিশোর। মেজাজ ভাল আছে রাবাতের। তবে বেশি আশা করা ঠিক না। কখন যে কি কারণে খেপে যাবেন, আন্দাজ করাও সম্ভব নয়।
.
০৪.
নাস্তা নয়, ভরপেট ভোজন হলো সান্তা বারবারায় পৌঁছে। পুরানো একটা বাড়ির চত্বরে টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই স্প্যানিশ কলোনির যুগে, তৈরি হয়েছিল বাড়িটা। কুয়াশা তাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। রোদ। বাতাস পরিষ্কার, তাজা।