মাকে উৎকণ্ঠা মুক্ত করে রিসিভার রেখে দিল সে। কিশোরের দিকে তাকাল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, কি বুঝলে? যাবে নানার সঙ্গে? তাকে সামলানো সম্ভব?
সন্দেহ ফুটল কিশোরের চোখে। তারপর উজ্জ্বল হলো। হেসে বলল, সহজ হবে না কাজটা। তবে একঘেয়েমিতে ভুগতে হবে না আমাদের, এটা বলতে পারি।
.
০৩.
পরের হপ্তায় বাবাকে বাড়িতে, দাওয়াত করলেন মিসেস আমান। বাবার পছন্দের সমস্ত খাবার তৈরি করে তার সামনে দিলেন। কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বাবাকে পটানোর চেষ্টা করলেন। মুসা, কিশোর আর রবিন তার। সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে গেলে যে মন্দ হয় না ইনিয়ে বিনিয়ে বললেন সে কথা। বোঝালেন, ওদের জন্যে এটাকে শিক্ষা সফর হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
ওপরে পুরু করে মাখনের স্তর দেয়া চকোলেট কেকে বড় বড় কামড় বসাচ্ছেন রাবাত। কথা বলতে অসুবিধে। ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন।
অমন করো কেন, বাবা? কণ্ঠস্বর আরও কোমল করলেন মিসেস। আমান। ছোটদের জন্যে বেড়ানো একটা বিরাট শিক্ষা, তুমিই তো বলতে আমাকে। বই পড়ে এ জ্ঞান অর্জন করা যায় না। আমাকে নিয়ে যেতে। সবচেয়ে মনে পড়ে কার্লসব্যাড ক্যাভানে বেড়াতে যাওয়ার কথা। কি যে ভাল লাগে ভাবতে! আমার সঙ্গে, মার সঙ্গে কত ভাল ব্যবহার করতে তুমি, মনে আছে, বাবা? মা মারা যাওয়ার পরই তুমি গেলে বদলে। সেই আগের তুমি আর এখনকার তুমিতে যে কত তফাৎ, যদি বুঝতে! তখন তোমাকে ঋষি, মনে হত আমার, বাবা, আর এখন
পাগল!
না না, তা নয়! তাড়াতাড়ি বললেন মিসেস আমান। তবে মেজাজটা যে তোমার ভাল থাকে না, এটা ঠিক। শোনো, বাবা, আমার একটা কথা রাখো, ওদেরকে তুমি নিয়ে যাও। আমি কথা দিতে পারি, ওরা তোমার। বিরক্তির কারণ হবে না। খুব ভাল ছেলে ওরা। দায়িত্বশীল।
নীরবে কেক খাওয়া শেষ করলেন রাবাত। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন। চিনি হয়নি। আরও এক চামচ চিনি মেশালেন। তারপর তাকালেন মেয়ের দিকে।
কুঁকড়ে গেলেন মিসেস আমান। ওই দৃষ্টি তার চেনা। কারও মনের ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নেয়ার ক্ষমতা আছে ওই দৃষ্টির। অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন তিনি।
তোর ধারণা দারোয়ান দরকার আমার? রাবাত বললেন, দারোয়ান। তুই ভালই জোগাড় করেছিস, নাক টিপলে এখনও দুধ বেরোয়! আমাকে কি পাহারা দেবে ওরা?
সে কি আমি জানি না? বিশ্বাস করো, পাহারা দেয়ার জন্যে ওদেরকে সঙ্গে দিচ্ছি না, বাবা। বরং ওদের দেখেশুনে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই তোমার। সঙ্গে দিতে চাইছি। গাড়িতে করে সেই নিউ ইয়র্ক যাওয়া, আমারই লোভ হচ্ছে! সংসারের ঝামেলা না থাকলে:
হাত নেড়ে মেয়েকে থামিয়ে দিলেন রাবাত। কাটা কাটা স্বরে বললেন, থাক, অত কথা বলতে হবে না! আমি বুঝে গেছি!
মিস্টার আমানের দিকে ফিরলেন তিনি।
একেবারে চুপ করে আছেন মুসার বাবা। শ্বশুরের সঙ্গে তর্ক করতে রীতিমত ভয় পান। তর্কটা শুধু তর্কে সীমাবদ্ধ থাকলে এতটা পেতেন না, কিন্তু লড়াই বেধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেজন্যে পারত পক্ষে কথা বলতে চান না শ্বশুরের সঙ্গে, এড়িয়ে চলেন।
এই মিয়া, তোমার কি বক্তব্য? জামাইকে প্রশ্ন করলেন রাবাত। দারোয়ান দরকার আছে আমার?
সেরেছে রে! এই ভয়টাই তিনি করছিলেন, তাকে না কোন প্রশ্ন করে বসেন। বড় করে ঢোক গিললেন। লম্বা দম নিলেন। সাবধানে শব্দ বাছাই করে বললেন, না না, দারোয়ান লাগবে কেন! তবে মাঝেমধ্যে সবারই কমবেশি অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়…
আমার হয় না! কর্কশ কণ্ঠে বললেন রাবাত। তোমরা ভাবছ রাস্তায় গণ্ডগোল করে আমি জেলে যাব, সেটা ঠেকাবে তোমাদের দারোয়ানেরা! তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, রোজই একবার করে জেলে যাই আমি। অ্যারেস্ট হয়েছিলাম যে সে-কথা মনে করিয়ে দিতে চাও। কিন্তু কেন গিয়েছিলাম? নিজের গাছ বাঁচাতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে। একে তুমি মারামারি বলতে পারো না। ধরো এখন তোমার সামনে থেকে জোর করে এই টেলিভিশনটা কেউ তুলে নিয়ে যেতে চাইল, বাধা দেবে না? সেই বাধাটাই আমি দিয়েছিলাম। পুরো দোষটা ছিল পার্ক ডিপার্টমেন্টের। আমার গাছ পোকায় খেয়ে মারুক, না ঝড়ে উড়ে যাক, তাতে ওদের কি? সেটাই বলতে গিয়েছিলাম। তাতে আমি হয়ে গেলাম পাগল, বদ্ধ উন্মাদ!
শ্বশুড়ের মারমুখো মূর্তি দেখে ঘাবড়ে গেলেন আমান। চুপ করে রইলেন। এখন তর্ক করতে যাওয়ার ফল হবে ভয়ঙ্কর।
জ্বলন্ত চোখে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত
দম বন্ধ করে ফেলল মুসা।
ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাবাত, এই, সত্যি করে বল, তোদেরকে দারোয়ান হিসেবে আমার সঙ্গে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না?
ঢোক গিলল মুসা।
আসল কথা ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে রেগে গেলেন মিসেস আমান। গলা চড়ে গেল তাঁর, তাতে কি হয়েছে? তোমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই যদি ভাবা হয়, ক্ষতিটা কি? তোমার পাকা খেতে মই দেয়া হচ্ছে নাকি! তুমি ভেবেছ তুমি ধমকাতে থাকবে আর সবাই তা সহ্য করবে? আমি বলছি, ভাল করে শুনে রাখো, আমি বলছি ওরা যাবে তোমার সঙ্গে। হয় ওরা যাবে, নয়তো তোমার নিউ ইয়র্ক যাওয়া বন্ধ। এতক্ষণ ভাল ভাবে বলেছি, শোনোনি। এই আমি বাকা হলাম, দেখি তুমি কি করতে পারো!
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাবা আর মেয়ে কেউ কারও চেয়ে কম যায়, না! মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল, আল্লাহরে, বাঁচাও! কি জানি কি ঘটে যায়! নানার মেয়ে খেপেছে!