ঘরের একধারে লম্বা টেবিলে নানা রকম অর্কিডের টব রাখা আছে। সেটার দিকেই আগ্রহ বেশি অতিথিদের। সেখানেই ভিড় করছে। বিলের। মোলায়েম স্বরে কাজ হলো না। জোরে জোরে বলতে হলো। তাতেও সুবিধে হলো না। শেষে চিৎকার করে টেবিল চাপড়ে কিছুটা রুক্ষ স্বরেই যখন বসতে বলল, তখন এক দুই করে সরে এল অতিথিরা। সারি দিয়ে রাখা খাটো পিঠওয়ালা চেয়ারে বসল। ছাতে ঝোলানো আলোগুলো ম্লান হতে হতে যখন প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল, তখন জ্বলে উঠল স্পটলাইট, আলো ফেলল স্পীকারস টেবিলের কাছে।
মাপা স্বরে বাছাই করা শব্দে অতিথিদের আরেকবার স্বাগত জানিয়ে, কি কারণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, জানাল বিল কংকলিন। ঘোষণা করল, স্যার মারিয়াট এখন আপনাদের তার চাষ করা কিছু অর্কিড দেখাবেন। কি করে বাজে প্যারেন্ট থেকেও উঁচু মানের অর্কিড জন্মানো যায়, সে-ব্যাপারে আলোচনা করবেন।
খাইছে! গুঙিয়ে উঠল মুসা। একেবারেই তো নীরস সাবজেক্ট! শুকনো, খটখটে! ঘুমিয়ে না পড়ি!
তার সামনের সীটে বসা মহিলা ফিরে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে কথা বলতে নিষেধ করল।
চেয়ারের পিঠ খাটো হওয়ায় আরাম করে হেলানও দিতে পারল না মুসা। তার মনে হলো, ইচ্ছে করে এ রকম চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে বিরক্তিকর বক্তৃতার সময় শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়তে না পারে, শুনতে বাধ্য হয়। তবু যতটা সম্ভব কাধ নিচু করে গা এলিয়ে দিল সে।
স্পীকারের টেবিলের ওপাশে এসে দাঁড়ালেন রোগাটে, প্রায় কঙ্কালসার, আপেলের মত টুকটুকে লাল মুখওয়ালা এক ভদ্রলোক। হাডিসার হাতের তালু ক্রমাগত ডলছেন। যেন করজোড়ে মিনতি করছেন তার ভয়াবহ বক্তৃতা শোনার জন্যে। বক্তৃতা ভয়াবহই হবে, বিলের কথা থেকেই আঁচ করে নিয়েছে মুসা। ইনিই প্রধান অতিথি স্যার ওয়ালথার মারিয়াট, পরিচয় করিয়ে দিল কংকলিন।
পুরো তিন সেকেন্ড কোন কথা বললেন না মারিয়াট। আন্তরিক হাসিতে কেবল দাঁত দেখালেন অর্কিড় প্রেমিকদের। তারপর বললেন, সম্মানিত ভদ্রমহোদয়গণ।
বলেই চুপ। আবার কয়েক সেকেন্ড দাঁত দেখানোর পর বললেন, কয়েক মিনিট আগে মিস্টার কংকলিন আমাকে বললেন, বক্তা হিসেবে একজন ভেজা চাষীকে পেয়ে আজকের সভা নাকি খুবই আনন্দিত। এর আগের সম্মেলনের বক্তা নাকি ছিলেন শুকনো চাষী। ভেজা চাষী কাকে বলেছেন, বুঝতে পারছেন তো? আমাকে।
চাষী কি করে ভেজা কিংবা শুকনো হয় মাথায় ঢুকল না মুসার। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল সে।
কনুই দিয়ে, তো মেরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল রবিন। তার মুখেও হাসি।
শব্দ করে হেসে ফেলার ভয়ে বন্ধুদের দিকে তাকাতে পারছে না। কিশোর। জোর করে চোখ আটকে রেখেছে ভেজা চাষীর ওপর।
পেছনে দরজা খোলার মৃদু শব্দ হলো। ফিরে তাকাল সে।
দয়া করে কি কেউ আলোটা নিভিয়ে দেবেন? অনুরোধ করলেন স্যার। মারিয়াট।
প্রায় লাফাতে লাফাতে ছুটে গেল কংকলিন। মাথার ওপরের আলোগুলো আগেই নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। স্পটলাইটটাও নিভে গেল। ক্ষণিকের জন্যে অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘর। একটা স্নাইড প্রোজেক্টর চালু হওয়ার হালকা গুঞ্জন শোনা গেল। পর্দায় আলো পড়ল। ছবি ফুটল। তাতে দেখা গেল, একটা গ্রীনহাউসে কাজে ব্যস্ত স্যার মারিয়াট। টেবিলে একের পর এক অর্কিড তুলে রাখছেন।
এখন শুনুন, কি করে ভাল, প্যারেন্ট বাছাই করব আমরা, আবছা অন্ধকারে আবার শোনা গেল তার কণ্ঠ। কুড়ি কিংবা ফুল দেখেই অনেক কিছু বোঝা যায়। যারা এর চাষ করে তাদের কাছে ওই জিনিস দুষ্প্রাপ্য নয়, ফুলের জন্যেই তো করে, তাই না? শ্রোতাদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন তিনি।
করিডরের দিকের একটা দরজা খুলে গেল। দরজায় এসে দাঁড়ানো গাট্টাগোট্টা একজন মানুষের অবয়ব প্রোজেক্টরের আলোর আভায় চোখে, পড়ল। ঘরের অন্ধকার চোখে সইয়ে নেয়ার অপেক্ষা করছে মনে হলো।
ছবিতে টেবিলের সামনে দাঁড়ানো মারিয়াট তখন নানা রকম ফাস্ক, বীজ আর গাছের চারা নাড়াচাড়া করছেন। কোনটা বাছাই করে কি ভাবে লাগালে ভাল ফলন আশা করা যাবে, বোঝাচ্ছেন।
অন্ধকার ঘরে ঢুকল আগন্তুক। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
মুসার গায়ে খোঁচা দিল কিলোর। আস্তে উঠে রওনা হয়ে গেল ঘরের পেছন দিকে। তাকে অনুসরণ করল মুসা আর রবিন।
খানিকটা সরে এসে ফিসফিস করে কিশোর বলল, ঢুকল যে, ওই লোকটা মিলার, কোন সন্দেহ নেই আমার। হোগারসনকে ফোন করব, দেখি পাওয়া যায় কিনা।
দরজার পাল্লা যতটা সম্ভব কম ফাঁক করে পিছলে বেরিয়ে এল সে। পেছনে বেরোল অন্য দুজন। দাঁড়িয়ে গেল ওখানে। নীরব করিডরে ফোন। কোথায় আছে খুঁজছে ওদের চোখ।
কাছেই আরেকটা দরজা খুলে গেল।
করিডর আর বলরুমের সঙ্গে যোগাযোগকারী বড় দরজাটা নয়, অন্য আরেকটা ছোট দরজা, প্যান্ট্রির কাছে।
মিলার? তিন গোয়েন্দাকে দেখে ফেলে বলরুম থেকে পালাচ্ছে? করিডরে নিশ্চয় ওদের আবছা অবয়ব চোখে পড়েছে তার। ত্রিমূর্তিকে চিনতে অসুবিধে হয়নি মিলারের।
বাঁয়ের ছোট হলটাতে পদশব্দ শোনা গেল। তারপর বাসন-পেয়ালার ঠোকাঠুকি। এবং তারপর একটা গুঞ্জন, নিচতলা থেকে উঠে আসতে আরম্ভ করেছে সার্ভিস্ লিফটটা।
পা টিপে টিপে এসে হলে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। লিফটের দিকে তাকাল। গাঢ় রঙের স্যুট পরা একজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। অন্ধকারে তার কাপড়ের রঙ বোঝা যাচ্ছে না, কালো দেখাচ্ছে। ওদের দিকে পিঠ। দুহাতে ধরা ট্রেতে কাপ-পিরিচ।