দুষ্টবুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল কিশোরের চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেবো না। ওকে আর দরকার হবে না। ইনকিউবেশন পিরিয়ড কালই শেষ হয়ে গেছে তোমার।
শক্ত হয়ে গেল মেয়েটা। সতর্ক হয়ে উঠল। ইনকিউবেশন! কেঁপে উল ফাটা বাঁশ। কিসের ইনকিউবেশন? ছোঁয়াচে রোগে ধরেছিল নাকি?
না না, মাথা নাড়ল মুসা, কিসের রোগ! ও এমনি এমনি বলছে! মিথ্যে বলা ওর স্বভাব!
মুসার বলার ভঙ্গিতে সন্দেহ আরও বাড়ল মেয়েটার। কিশোরের কাছ থেকে সরার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মুসার কাছে থাকাটাও বিপজ্জনক। কোন রোগ, কে জানে! চিকেন পক্সও হতে পারে! তাড়াতাড়ি সরে যেতে লাগল। সে। কামরার একেবারে আরেক ধারে চলে গেল। পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে গেল। পক্সের ভয়ে তার সঙ্গে নামল আরও কয়েকজন।
ম্যানহাটানে পৌঁছার আগেই আরও অনেকে নেমে গেল। ভিড় আর আগের মত নেই। কামরার মাঝখানে প্রচুর জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়েছে রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে। তাদের কাছাকাছি আসতে ভয় পাচ্ছে লোকে।
রাবাতকে বলল কিশোর, এফ বি আইয়ের লোকটা ট্রেনে উঠতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মে তাকে থেকে যেতে দেখেছে মুসা।
তাতে আর অসুবিধে কি? রাবাত বললেন। এখানে মিলারও নেই, তার দোস্তও নেই।
তা ঠিক। যাত্রীদের ওপর আরেকবার চোখ বোলাল তিন গোয়েন্দা। মিলার কিংবা ব্যালার্ডের সঙ্গে কারও সামান্যতম মিলও নেই।
ফোরটি-সেকেন্ড স্ট্রীটে এসে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল ওরা। একটা সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করলেন রাবাত, যেটা ধরে গেলে পথ বাঁচবে। অল্প সময়ে পৌঁছতে পারবেন হোটেলে। অন্ধকার সুড়ঙ্গমুখটা দেখতে ভাল লাগল না মুসার। মনে হলো, ওর মধ্যে ঢোকাটা উচিত হবে না। সমর্থনের আশায় রবিন আর। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কিছু বলল না ওরা। নীরবে এগোল রাবাতের। পিছু পিছু। অগত্যা মুসাকেও যেতে হলো।
সুড়ঙ্গের মাঝামাঝি পৌঁছে একটা ডাক কানে এল, দাঁড়াও, রাবাত!
পুরো সুড়ঙ্গটা নির্জন, নিজেদের বাদে আর কাউকে দেখেনি এত ক্ষণ। এবার দেখল। এগিয়ে আসছে আরেকজন। হাসি হাসি মুখ। বিচিত্র একটা রেনকোট পরা থাকায় আগের চেয়ে খাটোও লাগছে, মোটাও।
মিলার! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত।
যাক, দেখা তাহলে হলো, মিলার বলল। অনেক দিন পর, কি বলো।
নীরব সুড়ঙ্গ। এতটাই নীরব, কোথায় যেন টপ টপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে, তা-ও কানে আসছে।
পেছনে কথা বলে উঠল আরেকজন, ক্যামেরার ব্যাগটা আমি নিয়ে নিচ্ছি।
মনটিরেতে এই লোককেই দেখেছে গোয়েন্দারা, মিলারের দোস্ত, ব্যালার্ড। হাতে উদ্যত পিস্তল, রবিনের দিকে ধরে রেখেছে।
প্রতিবাদ না করে ব্যাগটা দিয়ে দিল রবিন।
ফিল্মগুলো আছে কিনা, দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে দেখে নিল লোকটা। মিলারের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, ঠিকই আছে। রাবাত আর গোয়েন্দাদের আদেশ দিল, ভেতরে যাও। সবাই।
পিস্তল দিয়ে সুড়ঙ্গের একটা দরজার দিকে ইশারা করল সে। খিল খুলে দিল মিলার। তার ওপাশে একটা দেয়াল আলমারি। সেঁতসেতে। ঝাড়ু, মেঝে পরিষ্কার করার স্পঞ্জ আর জীবাণু ও কীট-পতঙ্গনাশক ওষুধের টিনে বোঝাই।
ঢোকো! পিস্তল নেড়ে আবার আদেশ দিল ব্যালার্ড।
ঢুকতে বাধ্য হলো চারজনে। দরজা লাগিয়ে দেয়া হলো বাইরে থেকে। খিলটাকে ভালমত আটকে রাখার জন্যে তার মধ্যে কাঠি জাতীয় কিছু ঢোকানোর শব্দ পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে সরে গেল পদশব্দ।
বাঁচাও! চিৎকার করে উঠল মুসা। কে আছ, আমাদের এখান থেকে বের করো।
২১.
দীর্ঘ একযুগ পরে যেন রেলের একজন টিকেট বিক্রেতা এসে মুক্ত করল ওদের। রাবাতদের মতই সুড়ঙ্গ দিয়ে চলেছিল একজন পথচারী। আলমারির মধ্যে আজব আওয়াজ শুনতে পেয়ে সন্দেহ জাগে। রেলের অফিসে গিয়ে জানায়। একজন পুলিশ সঙ্গে নিয়ে এসেছে টিকেট বিক্রেতা। রাবাতকে প্রশ্ন শুরু করল পুলিশের লোকটা। কোন কথারই জবাব দিলেন না রাবাত। বিরক্ত হয়ে বরং এক ধমক লাগালেন তাকে। ছেলেদের নিয়ে সুড়ঙ্গ পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে হোটেলে ঢুকেই হোগারসনকে ফোন করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল হোগারসন। আগের মতই শান্ত।
এতে রাগ আরও বেড়ে গেল রাবাতের। ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। চিৎকার করে বললেন, এত কষ্ট করে টাকা কামাই করে ট্যাক্স দিই, সেই ট্যাক্সের টাকায় বেতন পান আপনারা, আর সেবা করার এই নমুনা। রাস্তাঘাটে জান নিয়ে টানাটানি পড়ে আমাদের। দুটো:ডেঞ্জারাস স্পাইকে ধরার জন্যে আপনাদের সাহায্য চেয়েছিলাম। আমাদের কাজ তো ঠিকমতই করেছি, আপনার লোক কোথায়? ঘুমোচ্ছিল নাকি?
অনেকটা সে-রকমই, মিস্টার রাবাত, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল। হোগারসন।
ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠলেন রাবাত। তাকে শান্ত করতে সময় লাগল হোগারসনের।
সারাদিন কোথায়, কি ভাবে কাটিয়েছেন, জানালেন তখন রাবাত। বার বার অভিযোগ করলেন দুর্গন্ধে ভরা, বাতাসহীন, ময়লা ঝাড়ুতে বোঝাই আলমারির মধ্যে আটকে থাকতে হয়েছে বলে।
জঘন্য! বলে বক্তব্য শেষ করলেন তিনি।
ঠিক, একমত হলেন হোগারসন। এ রকমটা ঘটা মোটেও উচিত হয়নি।
মেজাজ একেবারে নরম হয়ে গেল রাবাতের। এতক্ষণে বসলেন।
হোগারসন বলল, আমাদের এজেন্টরা সব ছড়িয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক থেকে বেরোনোর সমস্ত পথে পাহারা দিচ্ছে ওরা–এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন, সুড়ঙ্গমুখ, ব্রিজ, কোথাও বাদ নেই। শহর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলে ওই দুজন ধরা পড়বেই।