মিসেস কনসর ভি আই পি, সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আর কোন পরিচয় দিল না ঘোষক। তিন গোয়েন্দা ভাবল, এখানে উপস্থিত অতিথিরা নিশ্চয়।
মহিলার পরিচয় জানে, কেবল ওরা তিনজন আর মিস্টার রাবাতই জানেন না। হাসিতে ঠোঁট এত ছড়িয়ে ফেললেন মহিলা, মুসার ভয় হতে লাগল ছিঁড়ে না যায়। অল্প দুচারটা কথা বলেই সরে গেলেন।
আচমকা রাবাত আর তিন গোয়েন্দার দিকে নজর দিল ঘোষক। হাত তুলে স্বাগত জানানোর ভঙ্গি করল। মুহূর্তে ওদের দিকে ঘুরে গেল ক্যামেরার চোখ।
আর ইনি হলেন মিস্টার আরমান রাবাত, চেঁচিয়ে উঠল ঘোষক, যেন হঠাৎ করে তাকে চোখে পড়ে যাওয়ায় অবাক হয়েছে। অত্যন্ত সম্মানিত একজন মেহমান। বহুদূরের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছেন শুধু এই অনুষ্ঠানে, যোগ দেয়ার জন্যে।
ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসলেন রাবাত। ঘোষকের হাত চেপে ধরলেন। সহজে আর ছাড়তে চাইলেন না। ঘোষক বলল–পুরানো ওয়েস্টমোর হোটেলেটা যখন এখানে ছিল, তখন তার স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে এলে ওটাতে ছাড়া আর কোথাও উঠতেন না। তাঁর স্ত্রী এখন পরপারে; ঈশ্বর তার বিদেহী আত্মার মঙ্গল করুন!! তাড়াতাড়ি বলতে গেলেন রাবাত, আমি আর আমার স্ত্রী হানিমুন করেছি…
কথা শেষ করতে দিল না ঘোষক, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে দিল, অবশ্যই ওয়েস্টমোর হোটেলে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। পারল না।
গমগমে কণ্ঠে রাবাত বললেন, প্রায়ই আসতাম আমরা। ওয়েস্টচেস্টার পুড়ে যাওয়ার খবর শুনে তো রীতিমত মুষড়ে পড়েছিলাম। তবে আর চিন্তা নেই। ওটার চেয়ে ভাল হোটেল নিউ উইন্ডসর এখানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখনও কাঁচা কাঁচা গন্ধ আছে বটে, তবে কেটে যাবে। খুব শীঘি কেটে যাবে, ঠিকমত চালু হলেই। এই ছেলেগুলোকে নিয়ে এসেছি এবার, নিউ ইয়র্ক দেখাতে। এদের একজন আমার নাতি, অন্য দুজন তার বন্ধু ক্যামেরার চোখ ঘুরে গেল কিশোর, মুসা আর রবিনের হাসি হাসি মুখের দিকে। পুরো হপ্তাটাই এখানে কাটিয়ে যেতে চাই আমরা। খুব উপভোগ করছে ওরা। ইতিমধ্যেই রোলার কোস্টারে করে কনি আইল্যান্ড ঘুরিয়ে এনেছি ওদের।
এই সময় হাতের চাপ সামান্য শিথিল হতেই তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিল ঘোষক। তার পেশাদারী হাসিটা বিন্দুমাত্র মলিন না করে দ্রুত পিছিয়ে গেল। রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ধন্যবাদ দিল। ব্যস, কাজ শেষ।
ঘোষকের মতই তাড়াহুড়ো করে ওখান থেকে সরে এলেন রাবাত। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ছেলেদের দিকে তাকালেন, কি বলেছি আমি, বলো তো? ঠিকঠাক মত বলেছি তো সব?
হেসে মুসা বলল, দারুণ বলেছ তুমি, নানা। একটা ভুলই কেবল করেছ, ওয়েস্টমোরের জায়গায় ওয়েস্টচেস্টার বলে ফেলেছ।
তাই নাকি? মোটেও চিন্তিত মনে হলো না রাবাতকে। একই কথা। মিথ্যে যে এতগুলো বলতে পেরেছি, এই বেশি। নিউ উইন্ডসরে যে থাকব, এটা ঠিকমত বলেছি তো?
তা বলেছ।
তবে আর চিন্তা নেই। ওই ছুঁচো মিলারটাকে জানিয়ে দেয়া হলো, কোথায় আমাদের পাওয়া যাবে।
ওখানে থাকার আর কোন দরকার নেই। ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন রাবাত। সিটিক্রপ বিল্ডিঙের একটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে চললেন ওদের।
রিসিপশনের কাছে দাঁড়িয়ে ওদের বেরোতে দেখল হোগারসন। বাধা দিল না।
ভাবতে ভাবতে চলেছে তিন গোয়েন্দা, কাজ যা করার তো করা হলো। মিলার আসতে কত সময় নেবে?
.
২০.
পরদিন সকালে নাস্তা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তিন গোয়েন্দা, এই সময় হোটেলের কফি শপে ঢুকলেন রাবাত। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন, রাত জেগে টেলিভিশনে নিজের ইন্টারভিউ দেখেছেন। লেট নাইট নিউজ দেখেছেন, লেট-লেট নাইট নিউজ দেখেছেন। মূসার পাশে হাসিমুখে বসতে বসতে জানালেন, সকালের খবরেও তার ইন্টারভিউ দেখানো হয়েছে।
কফি শপে হোটেলের আরও অনেক মেহমান নাস্তা খাচ্ছে। ওদের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলেন, যেন সাংঘাতিক কেউকেটা কিছু হয়ে গেছেন। এখনই সবাই অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে সই নিতে ছুটে আসবে। খাতা না আনলেও মেনু হাতে এগিয়ে এল ওয়েইটার। তার মুখের দিকে তাকালও। তবে চিনতে পারার কোন লক্ষণ নেই তার চোখে।
রেগে গেলেন মনে হলো রাবাত। জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। আদেশ দিলেন, কফি। প্যানকেক। দুটো ডিম। আর গরুর মাংস ভাজা। এ চমকে গেল মুসা। নানা, তোমার না ডিম আর গরু খাওয়া বারণ। কোলেস্টেরল:..
চুলোয় যাক কোলেস্টেরল! ধমকে উঠলেন রাবাত। ময়লা জমলে, আমার শিরায় জমবে, তোর মাথাব্যথা কেন? আজ সারাদিনে অনেক ঘটনা ঘটবে, এনার্জি দরকার হবে আমার। সুতরাং সেটা এখনই জোগাড় করে নিতে, হবে।
কিন্তু খাওয়ার পর ঘটনা আর ঘটে না। এনার্জি খরচেরও প্রয়োজন পড়ছে রাবাতের। হোটেলের লবিতে বসে থাকার ব্যবস্থা করেছে তিন গোয়েন্দা। বার বার অহেতুক ক্যামেরা আর ক্যামেরার ব্যাগে হাত বোলাচ্ছে রবিন। এফ বি আইয়ের দুজনেই উপস্থিত। নীল ব্লেজার পরা লোকটা ঢুকেছে গিফট শপে, জিনিস দেখার ভান করছে। নিউজ কাউন্টারে ম্যাগাজিন ওল্টাচ্ছে বাদামী সোয়েটার।
আসছ না কেন, মিলার? বিড়বিড় করলেন রাবাত। আমরা তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।
তা কিন্তু তা-ও কিছু ঘটল না। আধঘণ্টা গেল। এক ঘণ্টা। ঘড়ির কাটা চলছে।
বেলা এগারোটায় মেজাজ গরম হতে আরম্ভ করল তার। সাড়ে এগারোটায় ফুটতে শুরু করল।