ভুরু কুঁচকে মুসার দিকে তাকালেন রাবাত। তোর মায়ের মাথায় গোবর বলেই তোর এই অবস্থা!
ফোড়ন কাটতে ছাড়ল না মুসাও, মগজ থাকার কি খেসারত যে দিতে হচ্ছে, সে-ও দেখতেই পাচ্ছি!
ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল কিশোরের মুখে। টেলিভিশন।
এইবার ভুরু কোঁচকানোর পালা মুসার। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, খাইছে! সত্যি সত্যি আবার নদীতে ঝাঁপ দিতে বলবে না তো? আমি রসিকতা। করছিলাম।
টেলিভিশনে যেতে হলে নদীতে ঝাঁপ দেয়া কিংবা বিল্ডিঙে চড়া লাগে না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কোনো কুইজ শোতে যেতে পারি। কিংবা নতুন মুখদের অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়া যেতে পারে।
হোটেল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যোগ দিলে কেমন হয়? রবিন বলল, পত্রিকায় পড়েছি, একটা নতুন হোটেল ভোলা হচ্ছে নিউ ইয়র্কে। নাম রাখা হচ্ছে নিউ উইন্ডসর। লোকের আগ্রহ আছে ওটার ওপর, কারণ, বছর দুই আগে পুড়ে যাওয়া আরেকটা হোটেলের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ওটা। অনেক বড় পার্টি দেবে। গভর্নরও আসতে পারেন।
কবে খুলছে?
কাল রাতে। গভর্নর এলে টিভির লোকেরা আসবেই ক্যামেরা নিয়ে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমাদের দাওয়াত পাওয়ারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে এফ বি আই। হোটেলটাতে ঘর নেয়া গেলে আরও সুবিধে। মিলার আর ব্যালার্ড জেনে যাবে কোথায় আছি আমরা।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। সোজা রওনা দিল নীল ব্লেজার পরা লোকটার দিকে। কাছে এসে বলল, কাল রাতে নিউ উইন্ডসরের উদ্বোধনী পার্টিতে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া কি এফ বি আইয়ের পক্ষে সম্ভব?
এত চমকে গেল লোকটা, হাত থেকে আইসক্রীম পড়ে গেল। ভাবতেই পারেনি তাকে চিনে ফেলবে একটা ছেলে।
টিভির নিউজ সেকশনের লোক নিশ্চয় আসবে, বুঝিয়ে বলল কিশোর। আইসক্রীম পড়ে যাওয়াটাকে পাত্তাই দিল না। লোকটার জুতোর ওপর পড়ে গলছে ওটা। হোটেলটা খোলার ব্যাপারে বাইরের লোকের মতামতও নিশ্চয় নেয়া হবে। প্রতিবেদক যদি আমাদের একজনকে প্রশ্ন করে, তাহলে বলতে পারি আমরাও ওই হোটেলে উঠেছি। ভাল লাগছে। হ্যারিস মিলার তখন জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি। সারা নিউ ইয়র্কে আমাদের পেছনে ঘুরে বেড়ানোর ঝামেলা থেকে বাঁচবেন আপনিও।
সামলে নিয়েছে ততক্ষণে লোকটা। লম্বা দম নিল। বলতে চাইল,–কিশোর কি বলছে সে বুঝতে পারছে না। তারপর ভাবল বোধহয়, অহেতুক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এই ছেলেকে বোকা বানাতে পারবে না। আরেকবার দম নিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়। জানাব।
রাস্তার দিকে চলে গেল সে।
বন্ধুদের কাছে ফিরে এল কিশোর। জানাবে বলে গেল।
কিন্তু আমাদের যে এখানে একা ফেলে গেল, রাবাত বললেন।
নানা, মরিয়া হয়ে বলল মুসা, অমন অসহায়ের মত ভঙ্গি কোরো না তো! তোমাকে অসহায় বলা, আর ভয়ানক শারম্যান ট্যাংককে খেলনা বলা। একই কথা। তোমার সঙ্গে লাগতে এলে বরং মিলারই অসহায় হয়ে যাবে।
মুসার কথায় হাসি ফুটল রাবাতের মুখে। মেজাজ অনেকটা ঠিক হয়ে এল। ট্যাক্সি নিয়ে রিভারভিউ প্লাজায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায়ই ফোন বাজল। রাবাত ধরলেন। হোগারসন করেছে। জানাল, নিউ উইন্ডসরে ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আগামী কাল যেন চলে যান।
গাঢ় রঙের স্যুট কিংবা রেজার আছে আপনাদের? জানতে চাইল হোগারসন। টেলিভিশনে চেহারা যদি দেখাতেই হয়, লোকে যাতে বোঝে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্যেই বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন আপনারা। তৈরি হয়ে এসেছেন।
কিন্তু নেই তো! কিছুটা নিরাশ মনে হলো রাবাতকে।
থাক, চিন্তা করবেন না। জোগাড় করে দেয়া যাবে।
.
১৯.
পুরোপুরি শেষ হয়নি হোটেল বাড়িটার কাজ। বিশাল গুহার মত দেখতে লবিটার বাতাসে রঙ আর অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের কড়া গন্ধ। লিফটের কাছে একজন রুম সার্ভিস ওয়েইটারের সঙ্গে দেখা। রবিনের অনুরোধে তাকে একটা ছাপানো নকশা দিল সে, তাতে হোটেলের কোন ফ্লোরে কি আছে দেখানো আছে। ওদের ঘরগুলো রয়েছে তেত্রিশ নম্বর ফ্লোরে। রিয়ারভিউর ঘরের চেয়ে ছোট। তবে ওটা যেমন চারদিক থেকে বদ্ধ, এটা তেমন নয়, রাবাতের ঘর থেকে ঈস্ট রিভার চোখে পড়ে।
পাঁচটার সময় হোটেলে এসেছে ওরা। লবিতে যন্ত্রপাতি বসিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে টিভির লোকেরা। ছয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে যখন এফ বি আইয়ের দেয়া গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার পরে নামল আবার, আলোয় ঝলমল করছে তখন লবিটা। মেসেজ ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে হোগারসন। ওদের প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল একজন প্রতিবেদকের সঙ্গে।
লম্বা, সুদর্শন একজন লোক। ঝকঝকে সাদা দাঁত। সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল। রাবাতের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় তাঁর বাঁ কানের পাশ দিয়ে পেছনে তাকাল। তারপর তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল একজন
মহিলাকে স্বাগত জানানোর জন্যে। রিভলভিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। মহিলা। গায়ের জ্যাকেটে প্রচুর ঝলমলে পুতি আর আয়নার টুকরো বসানো।
টিভি ক্যামেরার লাল আলো জ্বলে উঠল। একধারে দাঁড়ানো কানে হেডফোন পরা একজন ইঙ্গিত করল একজন ঘোষককে। ক্যামেরার সামনে এসে ঘোষক বলতে লাগল, সে নিউ উইন্ডসরের লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে যিনি রয়েছেন তার নাম মনিকা কনসর, হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। যোগ দিতে সেই রোম থেকে উড়ে এসেছেন।