শব্দ করে পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি। বিরক্ত চোখে ওগুলো দেখছেন বৃদ্ধ। রাগ হচ্ছে ভীষণ। গত চারদিনে একটি বারের জন্যে যেতে পারেননি–আবিষ্কার নিয়ে যেখানে যাওয়ার কথা, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি। সারাক্ষণ কেবল একই চিন্তা, একই কাজ–মিলার আর তার দোস্তকে আড়াল থেকে টেনে বের করে আনা। হোটেল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল, সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখের তারা। উত্তেজিত হয়ে যান। রবিনের কাছ ঘেঁষে থাকেন, সরেন না মুহূর্তের জন্যেও।
জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পটগুলোতে তাদের খোঁজা হতে পারে অনুমান করে ওসব জায়গাতেই এসে বসে থাকেন। নিউ ইয়র্ক সিটির দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘোরাফেরা করেন। সারাক্ষণ ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রাখে রবিন। যেখানে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ফিল্মের রোলগুলো বের করে দেখে। কেউ যদি চোখ রাখে, যাতে মনে করে ওগুলো ডেভেলপ করার অপেক্ষায় আছে।
প্রথম দিন জাহাজে করে ম্যানহাটান আইল্যান্ড ঘুরে এসেছে ওরা। সন্ধ্যায় ডিনার খেয়েছে একটা হোটেলের খোলা ছাতের ওপরের রেস্টুরেন্টে। একধারে ওখানে ক্রেতাদের মনোরঞ্জনের জন্যে পিয়ানো বাজায় বাদকদল। নিচে নিউ ইয়র্ক শহরের আলোকমালা, যেন আলোর এক বিশাল সমুদ্রের মত ছড়ানো। যেদিকে তাকানো যায় শুধু আলো আর আলো। শব্দেরও কমতি নেই। প্রাণবন্ত শহরের অবিরাম গুঞ্জন, চলছেই, চলছেই।
পরদিন খুব সকালে উঠল ওরা। ব্রুকলিন থেকে মাটির নিচের পথ দিয়ে গেল কনি আইল্যান্ডে। সেখানে আরও অনেক ট্যুরিস্টের সঙ্গে বিখ্যাত অ্যাকোয়ারিয়াম দেখল। পটেটো নিশ খেলো ওরা ওখানে। ঠোঁট চাটতে চাটতে কিশোর বলল, মেরিচাচীকে গিয়ে বলতে হবে এ কথা। সে তো মনে করে সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে ভাল নিশ সে-ই কেবল বানায়। এখানকারটা খেলে বুঝতে পারত কি জিনিস।
ধীরে ধীরে স্ট্যাচু অভ লিবার্টির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। দিন শেষে খাওয়া সারতে গেল ওঅর্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। এত উঁচুতে বসেছে, ছোট আকারের প্লেনগুলো উড়ছে ওদের নিচ দিয়ে। গোগ্রাসে গিলছে মুসা। চারপাশে তাকাচ্ছে। যেন বুঝতে পারছে না কোনদিকে আগে তাকাবে।
তৃতীয় দিনও ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটাতে লাগল ওরা। ঐতিহাসিক গ্রীনউইচ ভিলেজ দেখতে চলে গেল। দুপুরের খাওয়া খেলো চায়নাটাউনে।
লাঞ্চের পর তার ফরচুন কুকিতে পাওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে পড়লেন রাবাত। তার ভাগ্যলিপিতে বলা হয়েছে:
আজ রাতে প্রেমে সার্থক হবে তুমি।
তিন গোয়েন্দা তো হেসেই বাঁচে না। হাসতে লাগলেন রাবাতও। এমন উদ্ভট কথায় কে না হাসে? তারপর গেল ওরা রকেটির রেডিও সিটি মিউজিক হল দেখতে। ডিনার খেলো লিনডিতে। নিউ ইয়র্কের অসামান্য স্বাদের পনির কেক খেলো। রাতে হোটেলে ফিরে এতটাই ক্লান্ত বোধ করল, বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুম।
চতুর্থ দিন সকালে গেল মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অভ আর্টে, তারপর এসেছে সেন্ট্রাল পার্কে। বেঞ্চে বসেছে রোদের মধ্যে। ঠেলাগাড়িতে করে খাবার বিক্রি করছিল ফেরিওয়ালা। একজনকে ডেকে বিশেষ ধরনের রুটির ভেতরে ভেড়ার মাংস কেটে কেটে দিয়ে তৈরি করা সুভলাকি স্যান্ডউইচ কিনে খেয়েছে।
এখন, ওরা রয়েছে পার্কের আরেক প্রান্তে। মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্টরির সামনে।
এতসব ঘোরাঘুরির সময়, প্রায়ই বাদামী রঙের সোয়েটার আর ধূসর স্ন্যাকস পরা একজন তরুণকে আশেপাশে দেখেছে। আরও একজনকে দেখেছে নেভি ব্লেজার পরা, খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা, রুক্ষ চেহারার মাঝবয়েসী লোক। কখনও দুজনে একসঙ্গে থাকে, কখনও একজন এদিক থাকলে আরেকজন ওদিক।
এফ বি আইয়ের লোক, রবিন বলল। ওরা কাছাকাছি থাকলে সাহস পাই।
কিন্তু এরা কতটা কি করতে পারবে বুঝতে পারছি না, মুসার গলায় সন্দেহ। যাদের ধরতে এসেছে, বিশেষ করে মিলারের দোস্তটা একটা ইন্টারন্যাশনাল স্পাই। গোলাগুলি চলতে পারে।
এ সব আলোচনা বাদ দে, নিষেধ করলেন রাবাত। যখন চলে, দেখা যাবে। সামলানোর ক্ষমতা না থাকলে এদের পাঠাত না অফিস।
নানার মেজাজ খারাপ, আন্দাজ করতে পারল মুসা। অতিরিক্ত ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সকালে বিছানা থেকে উঠতেই কষ্ট হয়েছে। মুসা অবশ্য আসতে মানা করেছিল। বলেছে, নানা, শুয়েই থাকো। নাস্তার জন্যে খবর পাঠাচ্ছি। ঘরেই থাকি আজ। মিলারের কথা ভুলে যাই বরং। সে আর আমাদের খুঁজে পাবে না।
পাবে! প্রায় ধমকে উঠেছেন রাবাত। ওকে ধরার এই সুযোগ কোন কিছুর বিনিময়েই ছাড়তে রাজি নই আমি!
মিলারের প্রতি রাবাতের রাগ দেখে মুচকি হেসেছে কিশোর।
আজ কিছু ঘটবেই, রাবাত বলেছেন। মন বলছে আমার।
সুতরাং সেই মন বলার কারণেই এখন পার্কে বসে আছে ওরা। বিকেল। হয়ে গেছে। কিছুই ঘটেনি এখনও। বাদামী সোয়েটার পরা লোকটা নেই আশেপাশে। নীল ব্লেজার পরা লোকটা আছে। এককোণে দাঁড়িয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রীম কিনে খাচ্ছে। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি।
আমাদের আসলে চোখে পড়ছে না ওদের, মুসা বলল। এতবড় শহরে কোথায় খুজবে মিলার? এমন কিছু করা উচিত আমাদের, যাতে সবার নজরে পড়ে যাই–এই যেমন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিঙের দেয়াল বেয়ে ছাতে ওঠার চেষ্টা, কিংবা হাডসন নদীতে সাঁতার কাটা। টেলিভিশনে দেখানো হবে আমাদের। মিলার তখন জানতে পারবে আমরা কোথায় আছি।