একঘেয়ে দৃশ্য। ভাল লাগল না কিশোরের। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় এসে উঠল। চোখ মুদে ভাবতে লাগল, তদন্ত শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে এফ বি আইয়ের? মিলার আর সেই লোকটার ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেবে? আর কিছু ভাবতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল।
স্বপ্ন দেখল, বাড়িতে রয়েছে। স্যালভিজ ইয়ার্ডে। জঞ্জালের ভেতরে লুকানো ট্রেলারে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে ঢুকছে গোপন সুড়ঙ্গপথে। তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে তাকে, কারণ টেলিফোন বাজছে… বেজেই চলেছে…
উত্তেজিত অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘেমে গেছে। টেলিফোন আসলেও বাজছে, তবে হোটেলে তাদের ঘরে রাখা ফোনটা। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল রবিন। ঘুম জড়িত চোখে তাকিয়ে আছে কিশোর। রবিনকে বলতে শুনল, হ্যাঁ। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়!
রিসিভার রেখে কিশোরকে বলল, লবি থেকে হোগারসন ফোন করেছে। ওপরে আসছে।
হুড়াহুড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। মুসা দৌড় দিল নানাকে জাগানোর জন্যে। আলুথালু পোশাকে খালিপায়েই ছুটে এলেন। রাবাত। ঠিক এই সময় দরজায় টোকা পড়ল।
সঙ্গে করে আরেকজনকে নিয়ে এসেছে হোগারসন। তার চেয়ে লম্বা, বয়েসও কিছু বেশি। পরিচয় করিয়ে দিল, এজেন্ট পিটারম্যান। চেয়ারে বসল দুজনে। হোগারসন চুপ করে রইল, কথা বলতে লাগল পিটারম্যান।
মিলারের সম্পর্কে বেশির ভাগ প্রশ্নেরই জবাব দিলেন রাবাত। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। সকালের মত উত্তেজিত হলেন না, বলতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেললেন না। জানালেন, মিলারের ব্যাপারে কমই জানেন তিনি, অথচ বেশ কয়েক বছর ধরে লোকটা তার পড়শী, এত কাছাকাছি থাকলে আরও অনেক বেশি জানার কথা ছিল। কোন ধরনের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করে লোকটা, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব নেই–অন্তত রাবাত দেখেননি, অর্কিড জন্মানোর হবি। আর যে লোকটা মনটিরেতে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, রবিনকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল, তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বারোটা ছবি দেয়া হয়েছিল হোগারসনকে। সেগুলো বের করল পিটারম্যান। দ্বিতীয় লোকটার ছবি এর মধ্যে আছে কিনা জিজ্ঞেস করল। ছবিটা বের করে দিল রবিন। পুলিশের তোলা সাধারণ ছবি নয়। দামী পোশাক পরা অবস্থায় ভোলা হয়েছে। জায়গাটা দেখে মনে হলো বিমান বন্দর অথবা কোন রেল স্টেশনে রয়েছে। গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। যেন এইমাত্র নামল। বিমান কিংবা ট্রেন থেকে।
এর পরিচয় জানা গেছে? জানতে চাইল রবিন। রেকর্ড খারাপ, না ভাল?
ছবিটা খামে ভরে আবার পকেটে রেখে দিল পিটারম্যান। আগেও এর সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছে আমাদের। নাম একটা জানি, তবে সম্ভবত এটাও অনেকগুলো ছদ্মনামের একটা। ব্যালার্ড।
সঙ্গে করে আনা একটা অ্যাটাশে কেস খুলল হোগারসন। কয়েক রোল। ফিল্ম বের করল। দেখে মনে হলো, ব্যবহার করা হয়ে গেছে ওগুলো। ডেভেলপের অপেক্ষায় আছে। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রবিন, একটা সাহায্য করবে? তোমার ক্যামেরার কেসে ভরে রাখো এগুলো। অনেক উপকার হবে আমাদের। কেসটা চুরি যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যায় যাক। নষ্ট ফিল্ম এর ভেতরে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাবাত, প্রবল আপত্তি জানালেন, না না, এটা করা উচিত হবে না! ছেলেটাকে ফাঁদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। বিপদে পড়তে পারে ও। ওকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে ওর। বাবা-মা। আমি ওর ক্ষতি হতে দিতে পারি না।
হাসল হোগারসন। মিস্টার রাবাত, ভুল করছেন, ওকে টোপ আমরা বানাচ্ছি না। টোপ সে হয়েই আছে। তাকে বরং বাঁচানোর চেষ্টা করছি। মিলার আর তার সঙ্গী আপনাদের খুঁজে বের করবেই। ফিল্মটা ওদের চাই। রবিনকে আবার ধরবে ওরা। তখন যদি সে ফিল্ম দিতে না পারে, কি ঘটবে বুঝতে পারছেন?
বজ্রাহত মনে হলো রাবাতকে। বসে পড়লেন আবার। তারমানে কিছু একটা গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে সে। আপনারা তার ওপর নজর রাখবেন। তাকে অনুসরণ করবেন। যেই ওকে ধরবে, আপনারা ওদের আটকাবেন।
স্বীকারও করল না দুই এজেন্ট, অস্বীকারও করল না। কেবল রাবাতকে অনুরোধ করল, তারা নিউ ইয়র্ক কিংবা হোটেল ছেড়ে যাওয়ার আগে যেন ওদেরকে একটা খবর দিয়ে যান। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল দুজনে।
দরজা বন্ধ করেও সারতে পারল না মুসা, চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দারুণ হয়েছে। কাউন্টারস্পাই হিসেবে কাজ করার সম্মান দেয়া হলো আমাকে! এতদিন আমরা ছিলাম শিকার, এখন হলাম শিকারী। ডাকাতগুলো লেগে ছিল, আমাদের পেছনে, আমরা লাগব এবার ডাকাতের পিছে!
ডাকাত নয়, স্পাই, মনে করিয়ে দিল মুসা।
ওই হলো। স্পাইরাও আমার মতে একধরনের ডাকাত।
অত খুশি হয়ো না! গম্ভীর হয়ে বললেন রাবাত। তোমাকে ওরা টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে! শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন তিনি, পারছেন না। কল্পনাও করতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত এফ বি আইয়ের হয়ে কাজ করতে হবে। পড়শীকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাততে হবে সুদূর নিউ ইয়র্কে এসে!
.
১৮.
আর কত! ভোতা স্বরে বলল রবিন। চার চারটে দিন পেরিয়ে গেল, ওদের ছায়াটির দেখাও নেই!
দোষটা আমাদেরই, মুসা বলল, আমরাই তো খসানোর চেষ্টা করেছি। এখন পাওয়া যাবে কেন?
চুপ করে আছে কিশোর। আমেরিকান মিউজিয়াম অভ-নেচারাল হিস্টরির সামনে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে আছে চত্বরে দানা খুঁটে বেড়ানো কবুতরের ঝাকের দিকে। রাবাতের দিকেও লক্ষ রেখেছে।