মিলারের কাছেও একটা ক্যামেরা ছিল সেদিন, অবিকল রবিনেরটার মত। কিন্তু ছবি তুলছিল না। হাতে রেখে দিয়েছিল। তারপর দ্বিতীয় লোকটা এল। তাকে বলল মিলার–এনেছি ওটা। এর মানে কি? দ্বিতীয় লোকটার জন্যে কিছু নিয়ে এসেছিল মিলার। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে একটা বেঞ্চের সামনে দাঁড়াল, যেটাতে তখন রবিন বসেছিল। আমাদের চিনতে পারল মিলার। কি রকম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল মুখ মনে আছে? স্যুভনিরের দোকান থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে এলেন রাবুনো। দেখেই কেটে পড়ল মিলারের সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকটা। মিলারকে চেপে ধরলেন রাবুনো। ধমকাতে শুরু করলেন।
আবারও ভয় পেয়ে গেল মিলার। ওখানে রাবুনানাকে আশা করেনি, তাহলে নিশ্চয় আসত না। মিলারকে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে তার সঙ্গে যেতে বললেন রাবুনো। বেঞ্চে রাখা ক্যামেরাটা তুলে নিল রবিন। রওনা হলাম আমরা।
ওই সময় থেকেই শুরু হয়েছে যত গণ্ডগোল। আমাদের পিছু নিল মিলার। মনে আছে, আমাদের গাড়ির পেছন পেছন কি ভাবে দৌড়ে এসেছিল? কিছু বলছিল, আমরা বুঝতে পারিনি?
মাথা ঝাঁকাল মুসা।
রবিন তাকিয়ে রইল কিশোরের দিকে। ঠিক! কেন এসেছিল?
কারণ, যে ক্যামেরাটা তুমি তুলে নিয়েছিলে, ওটা তোমার ছিল না, রবিন। ওটা মিলারের। রাবুনানাকে তেড়ে আসতে দেখে আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে তাড়াতাড়ি রেখে দিয়েছিল বেঞ্চে।
তারমানে তুমি বলছ, মুসা বলল, ক্যামেরার পেছনেই লেগেছে সে? কিন্তু এরও তো কোন মাথামুণ্ড নেই। তার ক্যামেরা সে ফেরত চায়। মোটেলে এসে আমাদের দরজা খটখটালেই তো হত। বলত, তার ক্যামেরা ভুল করে আমরা নিয়ে এসেছি। ফেরত দিয়ে দিতাম। সাত রোজাতেই ফেরত নিয়ে যেতে পারত। এত চালাকি, এত পিছু নেয়ার কোন প্রয়োজন। পড়ত না।
শুধু ক্যামেরা হলে হয়তো তাই করত, কিংবা তা-ও করত না। মনটিরে থেকে সান্তা রোজায় গাড়ি চালিয়ে আসা কম ঝক্তি নয়, সাধারণ একটা ক্যামেরার জন্যে এ-কাজ করবে? তারপরও থামেনি। দীর্ঘ পথ আমাদের পিছে পিছে এসেছে। আমার ধারণা, ক্যামেরা নয়, ভেতরের ফিল্মের জন্যেই এমন করছে। ওটা ওদের কাছে দামী। ওই ফিল্মে কি আছে, সেটা আমাদের জানতে দিতে চায় না ওরা।
হ্যাঁ, মাথা দোলাল রবিন, এইটা হতে পারে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি। মনটিরে থেকে আসার পর এত তাড়াতাড়ি ফিল্ম ফুরিয়ে গেল কেন ক্যামেরার, কেন ক্যামেরা আর তার ব্যাগটা অন্য রকম লাগল। তখনও পুরোপুরি ধরতে পারিনি ব্যাপারটা, দুটোই নতুন ক্যামেরা বলে। তবে পরিবর্তন একটা টের পেয়েছি। ক্যামেরা বদল হতে পারে, ভাবলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলতাম। উঠে গিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা এনে বিছানায় উপুড় করল সে। নয় রোল ফিল্ম পড়ল বিছানায়, তার মধ্যে একটা কেবল নতুন, ব্যবহার করা হয়নি। বাকিগুলো ছবি তুলে শেষ করে ফেলা হয়েছে, ডেভেলপ করতে হবে। চলো, ক্যামেরার দোকানে। দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডেভেলপ করে দেয় এমন দোকান নিশ্চয় আছে।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। হোটেল থেকে তিন ব্লক দূরে ছোট একটা মলে পাওয়া গেল ক্যামেরার দোকান। কাউন্টারে বসা মহিলাকে ফিল্মগুলো বের করে দিল রবিন। ডেভেলপ করতে সময় লাগবে। বিভিন্ন দোকানের ডিসপ্লে উইন্ডোতে রাখা জিনিস দেখে সময় কাটাতে লাগল ওরা।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল ক্যামেরার দোকানে। শক্ত হলুদ কাগজের বড় একটা খাম ঠেলে দিল মহিলা। উত্তেজনায় প্রায় কাঁপতে কাঁপতে ওটা নিয়ে পার্কিং লটের দিকে এগোল রবিন। একটা নির্জন জায়গায় এসে খাম থেকে ছবির প্রিন্টগুলো বের করে দেখতে লাগল। দুপাশে দাঁড়িয়ে পাহারা। দিতে লাগল মুসা আর কিশোর। বার বার এদিক ওদিক চেয়ে দেখছে কেউ তাকিয়ে আছে কিনা। মাউন্ট রাশমোরে রাবুনো, কাস্টার পার্কে বাইসনের পাল, ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের ছবি। তার মধ্যে একটা বিমানের ছবি, রানওয়েতে ছুটতে ছুটতে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এটা আমি তুলিনি, রবিন বলল।
ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল মুসা। চেহারাটা বেশ ছিমছাম বিমানটার। বেশি সরু, অনেক লম্বা ছুঁচাল মাথা, পেটের কাছে ডানাদুটো হাঙরের পিঠের পাখনার মত চোখা হয়ে পেছনে বেঁকে গেছে। যাত্রীবাহী প্লেন নয়, আর্মির জিনিস।
বাকি ছবিগুলো ঘটতে লাগল রবিন। আরও কয়েকটা ছবি পাওয়া গেল, যেগুলো সে তোলেনি। তেল শোধনাগার আর ভারী মাল তোলার এলিভেটরের মাঝামাঝি কিছু যন্ত্র দেখা গেল। খুব কাছে থেকে তোলা ড্রয়িং আর নকশার ছবি রয়েছে। বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো আছে জিনিসগুলো। নোটবুকের কিছু লেখা পাতার ছবি আছে। নানা রকম সমীকরণ, নোট, অর্থহীন শব্দমালা লেখা রয়েছে পাতাগুলোতে, যেগুলো পুরোপুরি দুর্বোধ্য ওদের কাছে।
ছবিগুলো দেখা শেষ করল রবিন। ঘেমে গেছে। হু, মাথা দুলিয়ে বলল সে, এ সব জিনিসই তাহলে দ্বিতীয় লোকটাকে দিতে যাচ্ছিল মিলার! মনে তো হচ্ছে আর্মির গোপন কোন ব্যাপার! মিলার একটা স্পাই, দেশের বাইরের শত্রুর কাছে বিক্রি করে দিচ্ছিল এ সব তথ্য!
.
১৭.
এফ বি আইকে জানাতে হবে! চিৎকার করে উঠলেন রাবাত। ওরাই শয়তানগুলোর ব্যবস্থা করবে।
টেলিফোন ডিরেক্টরি টেনে নিয়েছে ততক্ষণে মুসা। দেখে বলল, এখানে নেই। এই শহরে এফ বি আইয়ের অফিস নেই।
না থাকারই কথা। নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওদের জানাতে হবে। চল চল, এখনই রওনা হব। সুটকেস গোছা।