অবশেষে দোকান খুলল। বুইকটার জন্যে যা দাম দিতে বলল সেলসম্যান, দর কষাকষি না করে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন রাবাত। দুই বছরের পুরানো একটা ফোর্ড সেডান কিনে নিলেন। বুইকের দাম বাবদ যা কাটা গেল, সেটা বাদ দিয়ে বাকি টাকার চেক লিখে দিলেন। তারপর আবার অপেক্ষার পালা। লং ডিসট্যান্ট কল করল সেলসম্যান। চেকটা ঠিক আছে। কিনা ব্যাংকে ফোন করে জেনে নেয়ার জন্যে।
ফোর্ড গাড়িটা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে দুপুর পেরিয়ে গেল।
এইবার আশা করি ঝেড়ে ফেলা যাবে ওদের, রাবাত বললেন। কড়া নজর রেখেছেন মিলার আর তার দোস্তকে দেখা যায় কিনা। বড় করে হাই তুললেন, চোখ ডললেন। নাহ, বয়েস বেড়েছে আমার। ধকল আগের মত সহ্য করতে পারব না, ভুলেই গিয়েছিলাম। আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না। আজ বরং এখানেই থেকে যাই। বিশ্রাম নিই। মিলারের ভয় আর না করলেও চলবে। ফোর্ডটা চিনতে পারবে না ও, আমাদেরও খোঁজ পাবে না।
আপত্তি তো নেইই, বরং খুশি হয়ে রাজি হলো গোয়েন্দারা। এই একটানা ছোটা ওদেরও ক্লান্ত করে তুলেছে। হলিডে ইনে ফিরে এল ওরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাবাতের নাক ডাকানোর শব্দ শোনা গেল।
মোটেলের পুলে সাঁতার কাটল তিন গোয়েন্দা। কাছের একটা ছোট গলফ কোর্সে গলফ খেলল। বেশি দূরে গেল না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরে এল। মুসা আর রবিন টেলিভিশন দেখতে লাগল। জানালার কাছে বসে কিশোর তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। বার বার ভ্রুকুটি করছে আর নিচের ঠোঁট ধরে টানছে। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। আচমকা মাথা ঝাঁকিয়ে আনমনেই বলল, ঠিক, এটাই আসল ব্যাপার!
ফিরে তাকাল অন্য দুজন।
কোনটা আসল ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।
রাবুনানার আবিষ্কারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই মিলারের, কিশোর বলল। কোনকালে ছিলও না।
স্তব্ধ হয়ে গেল মুসা। খাইছে! বলো কি! আগ্রহ না থাকলে আমাদের পিছু নিয়েছে কেন? কাস্টারে নেমে আমরা যখন বন দেখতে গেলাম, আমাদের পিছু নিল, তখন পিস্তল বের করেছিল কেন? তুমি কি বলতে চাইছ পিস্তল দিয়ে বাইসন শিকারে এসেছে সে?
সুপারমার্কেটে আমাকেই বা ধরেছিল কেন তার দোস্ত? রবিন বলল।
ওর কথাই ভাবছি আমি, কিশোর বলল। কেশে গলা পরিষ্কার করে সোজা হয়ে বসল। সুপারমার্কেটে ঠিক কি বলেছিল তোমাকে লোকটা, রবিন?
বলেছিল, আমি নাকি ওর ছেলে, নেশা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি, আমাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে। অতি সহজ চালাকি। আমাকে আটকে রেখে রাবুনানার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর আবিষ্কারটা চাইবে। জিনিসটা কি, বলো তো? কোন ধরনের অস্ত্র? নাকি দেশরক্ষা বাহিনীর কাজে লাগে এমন কিছু?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কিশোর বলল, ম্যানেজারকে কি বলেছে লোকটা, সেটা শুনতে চাই না। ঢুকেই তোমাকে কি বলেছিল?
তোমার সঙ্গে নেই ওটা। তবে অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।
তখন তোমার সঙ্গে কি জিনিস ছিল না?
আর কি? ঢোঁক গিলল রবিন। নিশ্চয় রাবুনোর আবিষ্কার।
কেন, আর কিছু হতে পারে না? এমন কিছু, যা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকে, কিন্তু সেই সন্ধ্যায় ছিল না?
ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। কিসের কথা বলছ?…ও, ক্যামেরাটা? ক্যামেরা এবং ক্যামেরার ব্যাগ। কিন্তু ওই সাধারণ জিনিসের প্রতি আগ্রহী হবে কেন লোকটা?
হাসল কিশোর। ক্যামেরার ব্যাগে তোমার ব্যবহার করা ফিল্মগুলো ছিল। মোটেলে রেখে গিয়েছিল। ওগুলোই চাচ্ছিল সে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার।
হেলান দিয়ে বসে দুই হাতের আঙুলের মাথাগুলো এক করল কিশোর, তাতে দেখাল অনেকটা তাবুর চুড়ার মত। হাসিটা লেগে আছে মুখে। পিজমো বীচে তার ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন রাবাত, চেহারাটা কি হয়েছিল মনে আছে? সাংঘাতিক চমকে গিয়েছিল। আতঙ্কিত। আমার বিশ্বাস, আমরা যা ভাবছি সে-কারণে পিজমো বীচে যায়নি সে, গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে।
ধরা যাক, ঘটনাক্রমেই আমাদের সঙ্গে ওখানে মিলারের দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের ওপর নজর রাখার জন্যে আসেনি। রাবুনানার বাড়িতেও আমরা বেরিয়ে আসার পর যে উঁকি মেরে দেখেছিল, সেটাও খুব সাধারণ ব্যাপার। উঁকিঝুঁকি মারা ওর স্বভাব। এক ধরনের কৌতূহল, পড়শীর ব্যাপারে যেমন থাকে কারও কারও। আমার চলে আসার পর মনটিরেতে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্যে বেরিয়েছিল সে। আমরা সান্তা বারবারায় থেমে লাঞ্চ খেলাম, কিন্তু সে সোজা চলে গেল পিজমো বীচে। সেখানে গিয়ে হয়তো খাওয়া সেরেছে, বা বিশ্রাম নিয়েছে। তারপর আমরা গেলাম। সৈকতে একই সময়ে বেরিয়েছিলাম। রাবুনো তো দেখেই গেলেন রেগে। মিলারের চোখে বিস্ময় দেখেছি আমি। ওর চেহারা মনে আছে?
সৈকত ধরে হেঁটে শহরের দিকে চলে গিয়েছিল সে। তারপরই বদলে গেল পরিস্থিতি। মনটিরেতে কি কি ঘটেছিল, মনে আছে তোমাদের?
আছে, মুসা বলল। আবার ওর সঙ্গে সৈকতে দেখা হলো আমাদের। অন্য লোকটাকেও ওখানেই দেখলাম–ক্যামেরার দোকানে রবিনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল যে।
হ্যাঁ। বাজি রেখে বলতে পারি ফিশারম্যান ওআর্কে আমাদের পিছু নিয়ে আসেনি মিলার। তাহলে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করত। এমন ভাবে চলাফেরা করত, যাতে আমাদের চোখে না পড়ে। কিন্তু তা সে করেনি। খোলাখুলিই সৈকতে হাঁটছিল সে, আর দশজন সাধারণ টুরিস্টের মত।
চোখের ওপর দুহাত চেপে ধরল কিশোর। পুরো দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করছে। খুঁটিনাটি বাদ না দিয়ে।