চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দুই গুণ্ডা।
আবার কিক মারল মুসা।
আবার গর্জে উঠল ইঞ্জিন। আর বন্ধ হলো না। গিয়ার দিয়েই এক্সিলারেটরে মোচড় দিল মুসা। খেপা ঘোড়ার মত লাফ মারল বাইক। এত শক্তিশালী মোটর সাইকেল আর চালায়নি সে। এতটা যে ক্ষমতা থাকতে পারে কল্পনাই করেনি। হ্যাঁচকা টান লেগে আরেকটু হলেই হাত থেকে ছুটে যাচ্ছিল হ্যান্ডেল। মনে হলো, কাঁধ থেকে বুঝি খসে গেল বাহু দুটো।
অসমান জমিতে ঝাঁকি খেতে খেতে একটা খাদের পাশ দিয়ে ছুটল বাইক, উঠে এল খোয়া বিছানো পথে। উড়ে চলল যেন। ভীষণ উত্তেজনায় গলা ফাটিয়ে জানোয়ারের মত চিৎকার করে উঠল মুসা। শক্তিশালী বাইক চালানোর মজাই আলাদা–মনে হয় ইঞ্জিন থেকে বাইকের গা বেয়ে আরোহীর শরীরেও এসে ঢোকে প্রচণ্ড ক্ষমতা। উন্মাদনা জাগে রক্তে। এক অদ্ভুত স্বাধীনতা বোধ। সেজন্যেই বোধহয় মোটর সাইকেল গ্যাঙ তৈরি হয়, গাড়ি বা আর কোন যানবাহনের গ্যাঙ হয় না।
পড়িমরি করে ছুটে এল দুই গুণ্ডা। অন্য বাইকটায় চড়ল, একজনের পেছনে আরেকজন। সামনের লোকটা স্টার্টারে কিক দিল। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। অভ্যস্ত হাত ওদের। এক্সিলারেটরে মোচড়ের তারতম্য হলো না, ফলে ইঞ্জিনও বন্ধ হলো না। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে আরম্ভ করল। কিন্তু মাত্র কয়েক গজ। খাদটার কাছে আসতে না আসতেই খুলে গেল সামনের চাকা।
শোনা গেল চিৎকার-চেঁচামেচি, খিস্তি করে গালাগাল। খাদে পড়ে গেছে। দুই গুণ্ডা।
দৌড় দিয়েছে ততক্ষণে রবিন আর কিশোর। রাবাতের কাছে চলে এল। দুদিক থেকে তার দুবাহু চেপে ধরে প্রায় চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটল গাড়ির দিকে। একটা মুহূর্ত বিমূঢ় হয়ে রইলেন তিনি, তারপরই যা বোঝার বুঝে গেলেন। ছেলেদের হাত ছুটিয়ে নিয়ে নিজেই ছুটলেন গাড়ির দিকে। দরজা খুলে উঠে পড়লেন ড্রাইভিং সীটে। অন্য পাশের দরজা খুলে প্যাসেঞ্জার সীটে বসল কিশোর, চাবি গুঁজে দিল রাবাতের হাতে। রবিন উঠল পেছনে। দরজা। পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই চলতে শুরু করল গাড়ি। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন রাবাত। পুরো একটা চক্কর দিয়ে রাস্তার দিকে ঘুরতে গিয়ে আধডজন ছোট ছোট ঝোপকে মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করে দিল। অল্পের জন্যে একটা গাছে বাড়ি লাগানো থেকে বেঁচে গেল নাকের একপাশ। দুই গুণ্ডা চমকের ধাক্কা কাটিয়ে কিছু করতে যাওয়ার আগেই রাস্তায় উঠে এল গাড়ি।
সিকি মাইল এসে গতি কমালেন রাবাত। ফিরে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
রাস্তায় উঠে এসেছে গুণ্ডারা। হাত মুঠো করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে প্রচণ্ড রাগে উন্মাদ নৃত্য জুড়েছে। নিষ্ফল আস্ফালন।
মুচকি হাসল কিশোর।
হাসতে লাগল রবিন।
১৬.
আধঘণ্টা পর ফিরে এল মুসা। কপালে ঘাম। চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। হেসে বলল, বাইকটা ফেলে দিয়েছি একটা ডোবায়। চাবি রেখে এসেছি একটা পিলার বক্সে। কিছু সময়ের জন্যে আটকে দিলাম ব্যাটাদের।
রাবাতের দিকে তাকাল সে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, নানা, কি হয়েছিল? এত গালাগাল শোনার শখ হলো কেন হঠাৎ? প্রচুর তো শুনলে-বাদুড়, ভাম! বাড়ি গিয়ে মাকে যদি বলি…কথা শেষ করতে পারল না হাসির জন্যে। মা এবং নানার কি চেহারা হবে কল্পনা করে হা-হা করে। হাসতে শুরু করল।
কিছুটা বিব্রত দেখাল রাবাতকে। আগে জানা থাকলে ধরতে পারত না। হঠাৎ করে এসে চমকে দিয়েছিল। যেটা থেকে তেল নেব বলেছিলাম সেটাতে ভিড় থাকায় মোড়ের পাম্পটায় চলে গেলাম। পেট্রোল নেয়ার পর মনে হলো, ট্যাংকের নিচে আবার যন্ত্র আটকে দেয়নি তো মিলার? রাস্তার ধারে সরে গিয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিয়ে দেখতে গেলাম। এই ফাঁকে আমার অজান্তে পাশে এসে দাঁড়াল শয়তান দুটো। ছুরি বের করে ভয় দেখাল, ওদের কথা না শুনলে হুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেবে। পিকনিক গ্রাউন্ডে গাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য করল আমাকে।
গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে রয়েছেন আপনি। এখনও যে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, এটাই বেশি।
থাক, অত ভাবতে হবে না, হাত নাড়লেন রাবাত। আমি তখন সতর্ক ছিলাম না বলে বেকায়দায় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর এলে আর সহজে ছাড়ব না, খানিকটা শিক্ষা দিয়ে দেব।
কি ভাবে শিক্ষাটা দেবে, বুঝতে পারল না মুসা। তবে নানাকে জিজ্ঞেস করার সাহসও হলো না। পুলিশকে জানালে কেমন হয়?
আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওদের আর জড়াতে চাই না। ওই হাদাগুলো এসে করবেই বা কি? শুধু শুধু একগাদা প্রশ্ন করে কেবল সময় নষ্ট করবে। শহর থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে রওনা হয়ে যাব, তাহলেই হবে।
পশ্চিমে?
হ্যাঁ। ওদিকে যাব ভাববেই না ওরা। গুণ্ডাগুলোও না, মিলার আর তার দোস্তও না। পশ্চিমের কোন শহরে উঠে পুরানো গাড়ির দোকানে যাব। বুইকটা বেচে দিয়ে অন্য গাড়ি নিয়ে নেব। আবার রওনা হব নিউ ইয়র্কের দিকে। বুইকটা না দেখলে ওরা চিনতে পারবে না, আমরাও জ্বালাতন থেকে বাঁচব।
নানার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল মুসা, হ্যাঁ, এইটা ভাল বুদ্ধি। বুইকটাই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। মিলার, তার দোস্ত, মোটর সাইকেলওয়ালারা, সবাই চিনে গেছে এটাকে। ওদের খসাতে হলে গাড়িটাই বিদেয় করতে হবে।
জলদি মালপত্র গুছিয়ে নে। এখুনি বেরোব।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার হাইওয়েতে এসে উঠল ওরা। পশ্চিমে চলল। মধ্যরাতে ওহাইও আর পেনসিলভানিয়ার সীমান্তে একটা শহরে ঢুকল। রাস্তাগুলো সব নির্জন। বেশির ভাগ বাড়িরই আলো নিভে গেছে। তবে হাইওয়ের পাশে হলিডে ইন হোটেলটায় আলো জ্বলছে। ঘর নিতে অসুবিধে হলো না। বাকি রাতটা নিরাপদেই ঘুমিয়ে কাটানো গেল। পরদিন সকালে উঠেই চলে এল একটা গাড়ির দোকানে। তখনও খোলেনি দোকানটা। অপেক্ষা করতে হলো ওদের।