এগোতে থাকল ওরা। খানিক পর সামনে আলো দেখা গেল। পথের বায়ে খোলা জায়গায় ক্যাম্প করেছে কেউ। আগুনের কাঁপা কাঁপা আলোয় দুটো লোককে দেখতে পেল ওরা। সতর্ক হয়ে পা টিপে টিপে এগোল। আরেকটু এগোতে বুইকটাও চোখে পড়ল। রাস্তা থেকে নামিয়ে আগুন থেকে সামান্য দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গাড়িটার কাছ থেকে কিছু দূরে, আগুন থেকে কাছে একটা কাঠের টেবিলের সামনে পিকনিক বেঞ্চে বসে আছেন রাবাত। আগুনের কাছে নড়াচড়া করা লোকগুলোর দিকে চোখ।
তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে পাথরের মত কঠিন যে হয়ে আছে, আন্দাজেই বুঝতে পারছে মুসা। ওই মোটর সাইকেল গ্যাঙেরই লোক! ফিসফিস করে বলল সে। নানাকে ধরে নিয়ে এসেছে।
চুপ থাকতে ইশারা করল তাকে কিশোর।
রাস্তা থেকে খোয়া বিছানো একটা পথ বেরিয়ে চলে গেছে পিকনিক গ্রাউন্ডের ভেতর দিয়ে। ওটা ধরে এগোল তিন গোয়েন্দা। লোকগুলোর দিকে চোখ থাকায় মোটর সাইকেল দুটো দেখতে পায়নি রবিন, আরেকটু হলে ওগুলোর ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। সাইকেল দুটোর আড়ালে বসে পড়ল ওরা।
আগুনের কাছে কথা বলছে লোকগুলো। এখান থেকে স্পষ্ট কানে আসছে।
এখনও তোমার কিছুই করিনি আমরা, বুড়ো বাদুড়, হুমকির সুরে বলল একজন, এমন জায়গায় ধরে নিয়ে যাব, এমন অবস্থা করে ছাড়ব, কেঁদে পার পাবে না তখন।
একটা ক্যান থেকে চো চো করে কিছু গিলল লোকটা কোন ধরনের। ড্রিংকস হবে। শেষ করে ক্যানটা আঙুলে চেপে দুমড়াল, কাঁধের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল পেছনে। মাটিতে রাখা একটা কাগজের থলে হাতড়ে আরেকটা ক্যান বের করল। আগেরটার মতই টান দিয়ে শেষ করে ফেলল এটাও। ফেলে দিয়ে, গুড়ুক করে ঢেকুর তুলে, শার্টের হাতা দিয়ে ঠোঁট মুছল।
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করলেন রাবাত। অসহ্য লাগছে তার, বোঝা গেল। আরেক দিকে মুখ ফেরালেন।
এই বুড়ো, ধমকে উঠল লোকটা, আরেক দিকে তাকাচ্ছ কেন? আমি কথা বলার সময়, আমার দিকে তাকাবে।
রাগে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। হাত ধরে টেনে আবার তাকে বসিয়ে দিল কিশোর।
অই বাদুড়, বলল লোকটা, পাহাড় বেয়ে দৌড়ে উঠেছ কখনও, এমন পাহাড় যেটাতে চড়ার সাধ্য নেই কারও?
হেসে উঠল দ্বিতীয় লোকটা। খুব ভাল লাগবে তোমার, ভাম–ওঠার আগেই যদি অবশ্য মরে না যাও।
হাসতে লাগল দুজনে।
মুসার হাত ছেড়ে দিয়েছিল কিশোর। হঠাৎ খেয়াল করল সে নেই তার। পাশে। অন্ধকারে কখন উঠে চলে গেছে! রেগে গেলে মুসার মাথার যে ঠিক থাকে না, কি না কি করে বসে, ভেবে মুখ শুকিয়ে গেল তার।
কিন্তু অঘটন না ঘটিয়ে ফিরে এল মুসা। দুজনের মাথা টেনে এনে কানে কানে বলল, শোনো, ওদের সাইকেলের চাবি লাগিয়ে রেখে গেছে। নানারটাও ইগনিশনেই ছিল, নিয়ে এসেছি। দেখাল সে। একে একে মোটর সাইকেলের চাবি দুটোও খুলে নিল।
নানাকে কোথাও আর নিয়ে যেতে পারবে না ওরা, বলল সে। এগুলো নিয়ে পাম্পটায় চলে যাও তোমরা। পুলিশকে ফোন করো। আমি পাহারা দিচ্ছি। নানার গায়ে হাত তোলার চেষ্টা যদি করে…আমি ওদেরকে…আমি ওদেরকে… ভয়ানক রাগে ফুঁসতে লাগল সে।
অন্ধকারে হাসল কিশোর। আরেকটা চমৎকার বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়।
দুটো সেকেন্ড চুপ করে বুদ্ধিটা মনে মনে খতিয়ে দেখল সে। কোন ভুল আবিষ্কার করতে পারল না। তবে এতে কাজ হবে। নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে। যেতে পারবে রাবাতকে। গুণ্ডাদুটোরও খানিকটা শায়েস্তা হবে।
তার চেয়ে আমার বুদ্ধি শোনো, ফিসফিস করে বলল সে, মোটর সাইকেল চালাতে জানো না?
প্রশ্নটা করে অন্য কিছু বোঝাতে চাইছে কিশোর। মুসা বলল, ওদের একটা বাইক সরিয়ে নিতে বলছ? পাগল নাকি?
না। পরিকল্পনার বাকি অংশটা বলল কিশোর।
সত্যি চমৎকার প্ল্যান, স্বীকার করতেই হলো মুসাকে। খুঁত না থাকলেও বিপদ আছে, তাতে সন্দেহ নেই। সাইকেল সে সরিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে কিশোর আর রবিন কি পেরে উঠবে দুটো বিশালদেহী গুণ্ডার সঙ্গে?
ভাবার সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেরি করলে। হয়তো রাবাতের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিতে পারে লোকগুলো।
বেশ, উঠে দাঁড়াল মুসা, তা-ই করব আমি!
অন্ধকারে গা ঢেকে ছায়ার মত নিঃশব্দে আবার বুইকের কাছে চলে গেল। মুসা। শব্দ না করে ট্রাংক খুলে কয়েকটা যন্ত্রপাতি বের করে আনল। ওগুলো নিয়ে কাজে লেগে গেল তিনজনে।
একের পর এক বিয়ারের ক্যান খালি করছে দুই গুণ্ডা। পেট ঢোল করে ফেলছে। নেশা ধরতে আরম্ভ করেছে। জিভ ভারী হয়ে আসছে। কথা কেমন। আড়ষ্ট আর এলোমেলো। মুসা ভাবল, কাজ করতে গিয়ে সামান্য শব্দ যদি হয়েও যায় এখন, খেয়াল করবে না ওরা। তবে শব্দ করল না। খুব সাবধানে। কাজ করতে লাগল।
ভাগ্যিস মাত্র দুজন এসেছে, কিশোর বলল। সবগুলো একসঙ্গে থাকলে মুশকিল হয়ে যেত। এ সব করতে পারতাম না।
একটা বাইকের ইগনিশনে চাবি ঢোকাল আবার কিশোর। দ্বিতীয় চাবিটা দিল মুসার হাতে। অন্য বাইকটার সীটের দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়েছে এখন ও।
বাইকটা বিশাল। সন্দেহ নেই, ক্ষমতাও নিশ্চয় সাংঘাতিক। হ্যাঁভেল ধরে ঠেলে স্ট্যান্ড থেকে নামাল ওটাকে। ইগনিশনে চাবি ঢুকিয়ে লম্বা দম নিল। কিক মারল স্টার্টারে।
রেগে যাওয়া জন্তুর মত গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন, পরক্ষণে বন্ধ হয়ে গেল।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা।