হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে। চলে আসবে। এত তাড়াতাড়ি পুলিশে খবর দেয়ার দরকার নেই।
মা, গাড়িটা নাকি ড্রাইভওয়েতেই আছে। হাঁটতে গেলেও কি দরজা খোলা রেখে যেত? কলই বা খোলা কেন?
হু! তা-ও কথা! চল, যাই!
উঠে দাঁড়াল কিশোর। আপনার যাওয়া লাগবে না, আন্টি, আগে আমরাই যাই। তিন গোয়েন্দার আসল কাজ পাওয়া গেছে, রহস্য। দরকার হলে আপনাকে ফোন করব।
.
০২.
মিস্টার রাবাতের বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন মিস্টার পেইত্রি। রোগাটে শরীর, চুলের অনেকখানি ধূসর হয়ে এসেছে, মুখের বাদামী চামড়া কুঁচকানো। বসন্তের এই উজ্জ্বল আলোকিত দিনেও মুখ বাদলের মেঘলা আকাশের মত অন্ধকার।
মুসাকে বললেন, তোমার নানার স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না! দাবা খেলার কথা দিয়ে কখনও মিস করেনি। তা ছাড়া আগের খেলায় হেরে গিয়ে খেপে আছে আমাকে হারানোর জন্যে। কোন ব্যাপারেই হার সহ্য করতে পারে না সে।
জানি, পেইত্রির সঙ্গে মুসাও একমত।
সামনের দরজায় তালা নেই। ভেতরে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পেছন পেছন এলেন পেইত্রি। নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটেছে। এ ভাবে দরজা খুলে, কল ছেড়ে রেখে দূরে যাওয়ার কথা নয়। কোন কারণে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। হয়তো এমন কিছু চোখে পড়েছিল, কল বন্ধ করার কথাও মনে ছিল না।
রান্নাঘরে ঢুকল গোয়েন্দারা।
সিঙ্কের ওপরে কলটার দিকে তাকাল কিশোর। ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তার প্রশ্নের জবাব চাইছে ওটার কাছে। বিড়বিড় করে বলল, পানি গরম। করতে যাচ্ছিলেন। কেটলির ঢাকনা খোলা। সিঙ্ক থেকে পানি নেয়ার সময়। জানালা দিয়ে সত্যি কিছু চোখে পড়েছিল তার? কি?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। ভাবছে, কি দেখেছিলেন রাবাত? লনের একটা অংশ চোখে পড়ছে। তার ওপারে সুন্দর করে ছাটা পাতাবাহারের বেড়া আলাদা করে দিয়েছে পাশের বাড়ির সীমানাকে। এ পাশটা যেমন পরিচ্ছন্ন, ওপাশটা তেমনি নোংরা। আগাছা হয়ে আছে, কেউ কাটে না। বাড়িটাও মেরামত হয় না কতদিন কে জানে। দরজার পাল্লা আর জানালার ফ্রেমের রঙ মলিন হয়ে গেছে, উঠে গেছে অনেক জায়গায়। ছাতের অবস্থা আরও খারাপ। বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে নাকি বাড়ির মালিক? নাহলে এত অযত্ন কেন?
ওটা কার বাড়ি? পেইত্রিকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যারিস মিলারের।
হাত নেড়ে মুসা বলল, নানা ওখানে যায়নি। ছায়া দেখতে পারে না। একজন আরেকজনের। দেখলেই ঝগড়া।
কিন্তু কেউ একজন গেছে ওই পাতাবাহারের বেড়া ফাঁক করে। দেখো, ডাল ভেঙে আছে। ভাঙা গোড়াটা এখনও সাদা, তারমানে গেছে যে বেশি দেরিও হয়নি।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠান দিয়ে বেড়ার দিকে এগোল ওরা।
বিড়বিড় করে নিজেকেই বোঝাল যেন কিশোর, বেড়াটা বেশি উঁচু না। মিস্টার রাবাতের পক্ষে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার পায়ে লেগেই ডালগুলো ভেঙে থাকতে পারে।
গুঙিয়ে উঠলেন পেইত্রি। আবারও ঢুকল। আগের বার কি কাণ্ডটাই না। করল! গুলি করার জন্যে বন্দুক বের করে ফেলেছিল মিলার। পাশের বাড়ির মিসেস ডনিগান পুলিশকে ফোন না করলে খুনই হয়ে যেত একটা। পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে রাবাত-মিলার নাকি তার ঘাস কাটার মেশিন চুরি করেছে। আর মিলার বলেছে, রাবাত তার গ্যারেজের তালা ভেঙে ঢুকেছে। পুলিশ একটা মিটমাট করে ক্রিয়ে গেছে বটে, তবে তাতে কোনই সমাধান হয়নি। শত্রুতা বন্ধ হয়নি দুজনের। হবেও না।
তাই নাকি! চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। আবারও ঢুকে থাকলে তো খুব খারাপ কাজ করেছেন। ধরে আনা দরকার।
গেলে তো আনবে।
দেখি গিয়ে।
বেড়া ডিঙানোর সময় আরও কয়েকটা ডাল ভাঙল কিশোর। তার সঙ্গী হলো মুসা আর রবিন। দ্বিধা করতে লাগলেন পেইত্রি। তবে শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে তিনিও ঢুকলেন মিলারের বাড়িতে।
অনেক ঘুরে পুরানো বিল্ডিঙটার দিকে এগোল চারজনে।
বেশি দূর যেতে হলো না। বাড়ি ছাড়িয়ে একটা গ্যারেজ, তার ওপাশে কাচ আর কাঠের তৈরি একটা গ্রীনহাউস। বাড়িটার মত অবহেলার শিকার নয়। এটা। কাঠের ফ্রেমগুলোতে নতুন সাদা রঙ করা। দেয়াল আর ছাতের কাচগুলোও পরিষ্কার, তবে কুয়াশা পড়েই বোধহয় ঘোলা হয়ে আছে।
হঠাৎ গ্রীনহাউসের আরেক প্রান্ত থেকে দরাজ গলায় ছড়া গান শোনা গেল:
এবার তুমি কোথায় যাবে,
পাজির রাজা মিলার?
ঘাড়টি তোমার মটকে দেবে,
পুলিশ ক্যাপ্টেন ফ্লেচার!
খাইছে! বলে উঠল মুসা, নানা!
কথা শুনে ওপাশ থেকে প্রশ্ন হলো, কে? গ্রীনহাউসের পাশ দিয়ে। বেরিয়ে এলেন রাবাত। লম্বা, ছিপছিপে শরীর। বয়েসের তুলনায় অনেক শক্ত সমর্থ এখনও। মুসার চুলের মতই খুলি কামড়ে আছে কুঁচকানো তারের মত কোকড়া চুল। তবে অত কালো নয়, বয়েসের রঙ লেগেছে তাতে, ধূসর হয়ে গেছে। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বললেন, আরি, তুই, মুসা! ও, তোমরাও এসেছ, রবিন আর কিশোরকে বললেন। পেইত্রি, মাপ করে দাও, ভাই। তোমার সঙ্গে দাবা খেলার কথা ছিল। দাঁড় করিয়ে রাখলাম।
দাড় করিয়ে রেখেছ তাতে কিছু মনে করছি না, কিন্তু ভয়টা পাওয়ালে কেন? আর কিছুক্ষণ না দেখলে পুলিশকে ফোন করতাম। তোমার মেয়েই দেরি করতে বলল। এখানে মরতে এলে কেন? আগের বারে আক্কেল হয়নি?
মরতে নয় মরতে নয়, মারতে, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত, মিলারকে। হাতের পেন্সিল কাটার ছুরিটা দেখালেন, এটা দিয়ে।